1. kalamazad28@gmail.com : risingcox.com : Rising Cox
  2. msalahuddin.ctg@gmail.com : RisingCox :
  3. engg.robel@gmail.com : risingcoxbd :
বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ০৬:১৬ অপরাহ্ন

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ছনের ঘর

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০
  • ২৫ Time View

আবদাল মাহবুব কোরেশী : বাঁশ, বেত, ছন, বিন্নাখড়, ইকড়, মই, লাঙ্গল, জোয়াল, পাইজং (কঞ্চি) উগার (যেখানে ধান রাখা হতো) উনদাল (রান্নাঘর) টঙ্গী, বাংলাঘর বা বৈঠকখানা ইত্যাদি গ্রামবাংলার জনজীবনে নিত্যদিন উচ্চারিত বাক্য বা শব্দ।

ইদানীং আর সেই সব শব্দ কারো মুখে উচ্চারিত হয় না বললেই চলে। দেখা যায় না, এক সময়ের গ্রামীণ জনপদের অতি পরিচিত সামগ্রী মাটির হাঁড়ি, বাটি, মাটির কলসি, বাসনসহ অনেক কিছু। মাটির হাঁড়িতে ভাত রাঁধা, কলসিতে পানি আনা আর মাটির প্লেটে (এ প্লেটকে তখন বলা হতো হানোক) ভাত খাওয়া ছিলো সাধারণ রীতি। নকশা করা এসব মাটির বাসন ছিলো নানা ঢঙের ও নানা রঙের। মাটি দিয়ে তৈরি এসব সামগ্রী রোদে শুকিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে এক ধরনের দক্ষ কারিগর তা তৈরি করতেন। ফেরিওয়ালারা ফেরি করে গ্রামের ঝি-বউদের কাছে এসব বাসন বিক্রি করতো। ঝি-বউরা দেখে শুনে নিজের প্রয়োজন অনুসারে তা রাখতেন। হাদিয়া বা মূল্য হিসাবে ধান অথবা চাল দিয়েই বেশির ভাগ সময় তারা ফেরিওয়ালাদের খুশি করতেন, আবার কখনো কখনো কাঁচা পয়সা বা টাকা দিয়ে মূল্য শোধ করতেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসব বাস্তবতা আজ শুধু কল্পনা। মাটির বাসনে আজ-কাল ঝি-বউরা ভাত রাঁধেনও না এবং তাদের স্বামী সন্তানদেরও এসব প্লেট বা হানোকে আর ভাত খেতেও দেখা যায় না। অতীতের সেই পরিবেশনা আজ গল্পের কালো অক্ষরে দীপ্তমান, যা পড়লে প্রবীণরা খুঁজে পায় তাঁর ছোট্টবেলার চঞ্চল দিনগুলোর রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ আর নতুন প্রজন্ম খুঁজে পায় ডালিম কুমারের গল্প, গোপাল ভাঁড় কিংবা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হাসির বাক্স। গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া এসব জিনিসকে উপলক্ষ করে আজকের লেখাটি আমার ছোট্ট বন্ধুদের সৌজন্যে সবার কাছে উপহার দিতে চাই আর আমার বিজ্ঞ বন্ধুদের নিয়ে যেতে চাই উনিশ শতক থেকে আরো আগের গ্রামবাংলার পথ-প্রান্তরে কিংবা মাটি দিয়ে তৈরি আর ছন দিয়ে চালা দেয়া ঘরের উঠোনে। যেথায় দেখা যাবে সামনে বিরাট পুকুর। তাল বা খেজুর গাছের এলোপাতাড়ি সিঁড়ি দেয়া পুকুরঘাট। ঘাটের এক কোণ দিয়ে গ্রাম্য বালক-বালিকাদের লাফালাফি। পুকুরে নন্দাই (পুকুরে এক ধরনের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা) খেলার জমজমাট আসর কাবাডি, ছোঁয়াছুঁয়ি, কিংবা বিশেষ ধরনের মাছ শিকার করার পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দারকানা, পুঁটি কিংবা ইঁচা জাতীয় মাছ শিকার অথবা বাড়ির এক কোনায় গোয়ালঘরে কয়েকটা গাভীর হাম্বাহাম্বা আকাশ ভাঙা চিৎকার। গোয়ালঘরের ঠিক বাম পাশে ইয়া মোটা খড়ের ফেইন (ধানের খড় দিয়ে তৈরি করা এক প্রকার গো-খাদ্য)। আর রশিক নাথের বেরশিক হাঁক- মাইজি গো, ও মাই..জি। রাখবেন নি… চিঁড়ার খই, ভেটের খই, আর মুড়ির খই ইত্যাদি.. ইত্যাদি। এ সবই আজ কল্পনার সাগরে ভাসমান। বাস্তবে এসবের দেখা আর মিলবে না। তবে আবহমান বাংলার এসব স্মৃতি বহন করে আগামী ভবিষ্যৎ সন্তানরা স্বর্ণালি একদিন আমাদের উপহার দিবে তা তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিতে হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ছনের ঘর নিয়ে কিছু গল্প না করলেই নয়। গল্প শুরু করার আগে ছন কী? কোথায় তার জন্ম? তার ব্যবহার পদ্ধতি-ই বা কী? এসব জানা তো আমাদের খুব দরকার। তাই চলো বন্ধুরা, এসো প্রথমেই জেনে নেই ছন আসলে কী?

ছন হলো গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা এক প্রকার ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। ছনের পাতা বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। কোনটা আড়াআড়ি লম্বা আবার কোনটা খাটো। বাংলাদেশে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বনজ উদ্ভিদ। এবং কোনো কোনো স্থানে ছন একটি অর্থকরী ফসলও বটে। সাধারণত এটি অনাবৃত পাহাড়ে জন্মে। তাই ছনকে পাহাড়ি অঞ্চলে-ই বেশি দেখা যায়। তবে অনেক স্থানে কখনো গুচ্ছভাবে পুকুর বা দিঘীর পাড়ে ছন দেখতে পাওয়া যায়। ছন তার বীজ ও মূল দিয়ে দ্রুত ছড়ায়। বাতাসের মাধ্যমে নতুন নতুন পরিবেশে ছনের বীজ ছড়িয়ে পড়ে এবং তার বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। সুতরাং ছন একবার ফলন পেলে এ ঘাস মূলের মাধ্যমে দ্রুত বংশ বিস্তার করে থাকে। বছরের আশ্বিন থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হয়। চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষ করা হবে তা পরিষ্কার করে দিলেই হয়। কিছুদিন পর প্রাকৃতিকভাবেই ছনের কুঁড়ি জন্ম নেয় এবং প্রাকৃতিকভাবেই তা প্রসার ঘটে। অতঃপর ছন প্রায় দেড় থেকে দুই হাত লম্বা হলে তার সকল আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। সম্ভব হলে একবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ফলন ভালো হয়। অন্যদিকে বাগানে বড় কোন গাছ থাকলে তার ছায়া ও পাতা পড়ে ছনের বৃদ্ধিতে যেমনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তেমনি ছনে পচন ধরে নষ্ট হয়। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। সুতরাং সে দিক থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ছন প্রায় ৬ থেকে ৭ ফুট লম্বা হলে তার পূর্ণতা পায় এবং কাটার উপযুক্ত হয়। এ সময় ছন কেটে ১৫ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। সবুজ রং থেকে ঝনঝনে বাদামি রং ধারণ করলে ছন ব্যবহারে উপযোগী হয়েছে বলে ধরে নিতে হয়।

গ্রামবাংলার ছনের ঘর

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে তার পরিচয় সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে। সুতরাং সমাজে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য তার বিশেষ বিশেষ কিছু উপাদানের প্রয়োজন হয়। সে কারণে মানুষের মৌলিক চাহিদার হিসাব মতে বাসস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সে উপাদানকে পায়ে ঠেলে একজন মানুষ জীবনের কঠিন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে বা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার নজির খুব একটা পাওয়া যায় না। কাঁচা হোক, আর পাকা হোক, নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকলে, তার মতো অসহায় আর কেউ হতে পারে বলে আমাদের জানা নেই। আল্লাহর সৃষ্টির সকল প্রাণী সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে একটা সময় সে তার আপন ঠিকানায় ঘরমুখো হবে, তা কোন গল্পকথা নয়, বাস্তবতা। সে বাস্তবতার রেশ ধরেই একটু সুখের জন্য মানুষ তার স্বাধ্যমত মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে প্রথমেই একটি ঘরের ব্যবস্থা করে থাকে। সে ঘরটা কেমন হবে, তা নির্ভর করে তার আয়-সঙ্গতির ওপর। সে হিসেবে তৎসময়ের গ্রামীণ সমাজের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই ছিলো গতরখাটা বা খেটে খাওয়া মানুষ। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’- এ রকম সমাজে ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঘর বাঁধা ছিলো তাদের কল্পনা বিলাস। সাধ আছে সাধ্য নাই এ রকম অবস্থায় বাঁশের তরজা অথবা ইকর দিয়ে বেড়া দেয়া ছনের ঘরকেই তাদের প্রথম বিলাস হিসেবেই পছন্দ করতো। তাই দেখা যেত ইকর বা বাঁশের তরজা দিয়ে তৈরি গ্রামের বেশির ভাগ দু-চালা ছনের ঘর। আবার কখনো কখনো মাটি দিয়ে তৈরি ছন দিয়ে ছাওয়া ঘরও দেখা যেত। মাটিকে বিশেষ কায়দায় কাদা করে একটি ঘরের দেয়াল তৈরি করা হতো। এ ক্ষেত্রে মাটির দেয়াল দিয়ে একটি ঘর তৈরি করতে মাসখানেক সময় লাগতো। তবে তা ছিলো একেবারেই যৎসামান্য। কারণ তুলনামূলকভাবে খরচের পাল্লা একটু বেশি হতো বিধায় বেশির ভাগ মানুষের তা তৈরি করা সাধ্যের মধ্যে ছিলো না। তা ছাড়া বৃষ্টির জমাটবদ্ধ পানি মাটির ঘরের জন্য ছিলো বিরাট হুমকি। বর্ষা ও বন্যার সময় জমাটবদ্ধ পানিতে অনেক মাটির ঘর ভেঙে পড়েছে, তার যথেষ্ট গল্প এখনো শুনা যায় মা-বাবা ও দাদা-দাদীর কাছ থেকে। সে কারণে মাটির ঘর তৈরির আগ্রহ মানুষের তেমন ছিলো না। যা তৈরি হতো তা নেহাত শখের বশে এবং তা ছিলো একেবারে হাতেগোনা।

ছনের ঘর যেভাবে তৈরি হতো

ছনের ঘর তৈরির প্রধান রসদই ছিলো গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা বনজ এই ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ, যার নাম ছন। পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এই ছন-ই ছিলো তৎকালীন সময়ে গ্রামবাংলার মানুষের ঘরের ছানি বা চাল। ঘরের অবকাঠামো অর্থাৎ বেড়া তৈরি হতো এক প্রকার বনজ উদ্ভিদ ‘ইকর’ অথবা এক প্রকার বাঁশকে খণ্ড খণ্ড করে জালিফলা করে তরজার মাধ্যমে। চাল তৈরি করতে ছোট ছোট মুলিবাঁশ ব্যবহার করা হতো। প্রথমেই মুলিবাঁশকে বিশেষ কায়দায় পিঞ্জিরার মতো করে বাঁশের বেত অথবা জালিবেত দিয়ে শক্ত করে একে অপরটির সাথে বেঁধে দেয়া হতো। এই পিঞ্জিরার মতো বেঁধে দেওয়া চালের ওপর বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে দেয়া হতো। কয়েকটি ধাপে ছনগুলোকে বিন্যাস করে তার ওপরে বাঁশ দিয়ে বেতের মাধ্যমে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হতো। তখন স্থানীয় ভাষায় তাকে ছাউনি বলা হতো। পরবর্তীতে এই ছাউনিকে লাঠিপেটা করা হতো এবং তার ওপর বেশি করে পানি ঢালা হতো যাতে ছনগুলো এলোমেলো না থেকে সোজা হয়ে বাঁশের ওপর ভালো করে বসে যায় ও ছাউনির কোন ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরের ভিতরে পানি প্রবেশ করে কি না তাও দেখা যায়। এভাবেই ছন দিয়ে অন্তত প্রতি দু-এক বছর পর চাল ছাওয়া হতো। মুরব্বিদের কাছ থেকে জানা যায়, সে সময়কালে গ্রামবাংলার গৃহনির্মাণ রীতি ছিল খুবই সরল। সাধারণত সামনে ও পিছনে বারান্দা রেখে দুই কক্ষবিশিষ্ট দু’চালা ঘরই বেশি দেখা যেত। আলাদা করে রান্নাঘর রাখলেও মূল ঘরের সাথে এর সংযোগ থাকতো। আবার কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও হতো। তুলনামূলকভাবে সচ্ছল লোকেরা দিনমজুরকে দিয়েই ছাউনি বাঁধার কাজ সারতেন। তবে সাধারণ মানুষের বেলায় তা ছিলো সম্পূর্ণ এক আলাদা রেওয়াজ। যেমন কারো বাড়িতে চালা তৈরি করার সময় হলে তিনি সারা গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দিতেন। লোকেরা তার দাওয়াত সানন্দে গ্রহণ করতো। এবং চালা তৈরির কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামের যুবক প্রৌঢ় এমনকি বৃদ্ধরাও তার বাড়িতে ভিড় করতেন। এটা ওটা কাজের ফাঁকে কোরাসকণ্ঠের গান তার সাথে হাসি-তামাশা, হৈ-হুল্লোড়সহ এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতো। হেসে খেলে লোকেরা নিজ দায়িত্বে যৌথশ্রমে নিমিষেই শেষ করে নিতেন ঘরের ছাউনি দেওয়ার কাজ। তারপর শুরু হতো ভোজনবিলাসের আনন্দপর্ব। গৃহকর্তা সাধ্য অনুযায়ী খাবারের ব্যবস্থা রাখতেন। এ ক্ষেত্রে ডাল সবজি সাথে গৃহকর্ত্রীর সবচেয়ে মোটা ও বড় লাল মোরগটা জবাই করে দুপুরের আহারের ব্যবস্থা করা হতো, সাথে পান-সুপারি আর তামাক-তো ছিলো-ই, যা বড়দের সুখের টান আর ঠোঁট লাল করতে পান-সুপারি চিবোতে কখনো ভুল-ই হতো না। শ্রমের মূল্য হিসেবে এই ছিলো তাদের সর্বোচ্চ চাওয়া এবং পাওয়া। এখানে টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার ছিলো না। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আর একে অপরের প্রতি ভালোবাসার টানটাই ছিলো সবচেয়ে বড়। সামাজিক সম্প্রীতি আর একে অন্যকে ভালোবাসা এবং সাহায্য করার এই রীতি ছিল তৎকালীন সময়ে গ্রামবাংলার মানুষের চির-অহঙ্কার। শত ব্যস্ততা আর হাজার কষ্টের মাঝেও শত বছর থেকে চলে আসা তাদের এই চমৎকার ঐতিহ্য কোন লোকদেখানোর ব্যাপার ছিলো না। ছিলো, ভাই ভাইকে সাহায্য করার অনন্য এক বিবেকবোধের প্রকাশ। সবচেয়ে ভালো দিকটা ছিলো তাদের এই বিবেকবোধ শুধু কোন এক গোষ্ঠীভিত্তিক ছিলো না, ছিলো ধর্ম-বর্ণ সবার প্রতি সমান, যা বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করলে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র সমাজ শুধু লজ্জাই পাবে না, নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বাধ্য হবে। অবশ্য সে বোধোদয় আর তা অনুভব করার যোগ্যতা যদি থাকে! কারণ আত্মকেন্দ্রিক বর্তমান সমাজব্যবস্থা আজ আমাদের সরল বিবেকবোধকে একেবারে অন্ধ করে দিয়েছে। আমরা আজ নিজেকে নিয়ে নিজেদের সাথেই প্রতারণা করছি। সুতরাং এই ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের স্বার্থে। আগামী প্রজন্মের স্বার্থে।

পরিশেষে বলা যায়, গ্রামের সেই সহজ-সরল মানুষের সরল সমীকরণ আজ যেমন চোখে পড়ে না, ঠিক তেমনি চোখে পড়ে না আমাদের হাজারো বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্যে। বিজ্ঞানের এই নব নব আবিষ্কার কেড়ে নিতে বসেছে আমাদের গ্রামীণ সমাজের শেষ চিহ্নটি। ইট-বালু আর সিমেন্টের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের মূল্যবান অনেক কিছু, যা পুষিয়ে নেয়া আর কখনো যাবে কি না সন্দেহ। তবে এ কথা ঠিক যে, সেদিনটি আর খুব বেশি দূরে নয়; যেদিন ছনের ছাউনি ও তরজা দেয়া ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে উঠে যাবে। গ্রামের সরল মানুষের সরলতাও হাসির খোরাক হবে। বাঁশ, বেত, ছন, বিন্নাখড়, ইকড়, মই, লাঙ্গল, জোয়াল, পাইজং (কঞ্চি) উগার (যেখানে ধান রাখা হতো) উনদাল (রান্নাঘর) টঙ্গী, বাংলাঘর বা বৈঠকখানা ইত্যাদি গ্রামবাংলার জনজীবনে নিত্যদিন উচ্চারিত বাক্য বা শব্দ। ইদানীং আর সেই সব শব্দ কারো মুখে উচ্চারিত হয় না বললেই চলে। দেখা যায় না, এক সময়ের গ্রামীণ জনপদের অতি পরিচিত সামগ্রী মাটির হাঁড়ি, বাটি, মাটির কলসি, বাসনসহ অনেক কিছু। মাটির হাঁড়িতে ভাত রাঁধা, কলসিতে পানি আনা আর মাটির প্লেটে (এ প্লেটকে তখন বলা হতো হানোক) ভাত খাওয়া ছিলো সাধারণ রীতি। নকশা করা এসব মাটির বাসন ছিলো নানা ঢঙের ও নানা রঙের। মাটি দিয়ে তৈরি এসব সামগ্রী রোদে শুকিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে এক ধরনের দক্ষ কারিগর তা তৈরি করতেন। ফেরিওয়ালারা ফেরি করে গ্রামের ঝি-বউদের কাছে এসব বাসন বিক্রি করতো। ঝি-বউরা দেখে শুনে নিজের প্রয়োজন অনুসারে তা রাখতেন। হাদিয়া বা মূল্য হিসাবে ধান অথবা চাল দিয়েই বেশির ভাগ সময় তারা ফেরিওয়ালাদের খুশি করতেন, আবার কখনো কখনো কাঁচা পয়সা বা টাকা দিয়ে মূল্য শোধ করতেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসব বাস্তবতা আজ শুধু কল্পনা। মাটির বাসনে আজ-কাল ঝি-বউরা ভাত রাঁধেনও না এবং তাদের স্বামী সন্তানদেরও এসব প্লেট বা হানোকে আর ভাত খেতেও দেখা যায় না। অতীতের সেই পরিবেশনা আজ গল্পের কালো অক্ষরে দীপ্তমান, যা পড়লে প্রবীণরা খুঁজে পায় তাঁর ছোট্টবেলার চঞ্চল দিনগুলোর রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ আর নতুন প্রজন্ম খুঁজে পায় ডালিম কুমারের গল্প, গোপাল ভাঁড় কিংবা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হাসির বাক্স। গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া এসব জিনিসকে উপলক্ষ করে আজকের লেখাটি আমার ছোট্ট বন্ধুদের সৌজন্যে সবার কাছে উপহার দিতে চাই আর আমার বিজ্ঞ বন্ধুদের নিয়ে যেতে চাই উনিশ শতক থেকে আরো আগের গ্রামবাংলার পথ-প্রান্তরে কিংবা মাটি দিয়ে তৈরি আর ছন দিয়ে চালা দেয়া ঘরের উঠোনে। যেথায় দেখা যাবে সামনে বিরাট পুকুর। তাল বা খেজুর গাছের এলোপাতাড়ি সিঁড়ি দেয়া পুকুরঘাট। ঘাটের এক কোণ দিয়ে গ্রাম্য বালক-বালিকাদের লাফালাফি। পুকুরে নন্দাই (পুকুরে এক ধরনের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা) খেলার জমজমাট আসর কাবাডি, ছোঁয়াছুঁয়ি, কিংবা বিশেষ ধরনের মাছ শিকার করার পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দারকানা, পুঁটি কিংবা ইঁচা জাতীয় মাছ শিকার অথবা বাড়ির এক কোনায় গোয়ালঘরে কয়েকটা গাভীর হাম্বাহাম্বা আকাশ ভাঙা চিৎকার। গোয়ালঘরের ঠিক বাম পাশে ইয়া মোটা খড়ের ফেইন (ধানের খড় দিয়ে তৈরি করা এক প্রকার গো-খাদ্য)। আর রশিক নাথের বেরশিক হাঁক- মাইজি গো, ও মাই..জি। রাখবেন নি… চিঁড়ার খই, ভেটের খই, আর মুড়ির খই ইত্যাদি.. ইত্যাদি। এ সবই আজ কল্পনার সাগরে ভাসমান। বাস্তবে এসবের দেখা আর মিলবে না। তবে আবহমান বাংলার এসব স্মৃতি বহন করে আগামী ভবিষ্যৎ সন্তানরা স্বর্ণালি একদিন আমাদের উপহার দিবে তা তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিতে হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ছনের ঘর নিয়ে কিছু গল্প না করলেই নয়। গল্প শুরু করার আগে ছন কী? কোথায় তার জন্ম? তার ব্যবহার পদ্ধতি-ই বা কী? এসব জানা তো আমাদের খুব দরকার। তাই চলো বন্ধুরা, এসো প্রথমেই জেনে নেই ছন আসলে কী?

ছন হলো গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠা এক প্রকার ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। ছনের পাতা বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। কোনটা আড়াআড়ি লম্বা আবার কোনটা খাটো। বাংলাদেশে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বনজ উদ্ভিদ। এবং কোনো কোনো স্থানে ছন একটি অর্থকরী ফসলও বটে। সাধারণত এটি অনাবৃত পাহাড়ে জন্মে। তাই ছনকে পাহাড়ি অঞ্চলে-ই বেশি দেখা যায়। তবে অনেক স্থানে কখনো গুচ্ছভাবে পুকুর বা দিঘীর পাড়ে ছন দেখতে পাওয়া যায়। ছন তার বীজ ও মূল দিয়ে দ্রুত ছড়ায়। বাতাসের মাধ্যমে নতুন নতুন পরিবেশে ছনের বীজ ছড়িয়ে পড়ে এবং তার বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। সুতরাং ছন একবার ফলন পেলে এ ঘাস মূলের মাধ্যমে দ্রুত বংশ বিস্তার করে থাকে। বছরের আশ্বিন থেকে চৈত্রমাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হয়। চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষ করা হবে তা পরিষ্কার করে দিলেই হয়। কিছুদিন পর প্রাকৃতিকভাবেই ছনের কুঁড়ি জন্ম নেয় এবং প্রাকৃতিকভাবেই তা প্রসার ঘটে। অতঃপর ছন প্রায় দেড় থেকে দুই হাত লম্বা হলে তার সকল আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। সম্ভব হলে একবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ফলন ভালো হয়। অন্যদিকে বাগানে বড় কোন গাছ থাকলে তার ছায়া ও পাতা পড়ে ছনের বৃদ্ধিতে যেমনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তেমনি ছনে পচন ধরে নষ্ট হয়। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। সুতরাং সে দিক থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ছন প্রায় ৬ থেকে ৭ ফুট লম্বা হলে তার পূর্ণতা পায় এবং কাটার উপযুক্ত হয়। এ সময় ছন কেটে ১৫ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। সবুজ রং থেকে ঝনঝনে বাদামি রং ধারণ করলে ছন ব্যবহারে উপযোগী হয়েছে বলে ধরে নিতে হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023 Rising Cox
Theme Customization By NewsSun