নঈম আল ইস্পাহান : প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেলকনিতে বেতের চেয়ারটাতে বসে চারতলা থেকে রাস্তার মানুষজন দেখতে দেখতে চা খাওয়ার অভ্যেস নিশাতের। ধানমন্ডির এই বাসাটাতে সে একা একা থাকে।সকালে ঘুম থেকে উঠেই ধানমন্ডি লেক থেকে একবার ঘুরে আসা তার নিত্য দিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। তারপর শাওয়ার নিয়ে হালকা নাস্তা করে অফিস। টানা বিকেল পর্যন্ত ব্যস্ততা। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা।
নিশাত একটা ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে চাকরি করে।ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল নিজের একটা আলাদা ফ্ল্যাট থাকবে। বাসায় অন্তত চারটা রুম থাকবে। একটা রুম হবে একান্ত তার ব্যক্তিগত। যেখানে কেউই ঢুকতে পারবেনা। রুমে থাকবে তার পছন্দের সব কিছু। যেমন প্রিয় লেখকদের বই, বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম, প্রিয় গায়কের গানের ক্যাসেট, বিভিন্ন দামি দামি ঘর সাজানোর শোপিস। থাকবে একটা অতি মূল্যবান ইজি চেয়ার।যেটাতে নিশাত দুলতে দুলতে চিন্তা করবে। ভাববে তার ভবিষ্যৎ, বর্তমান নিয়ে। একটি ড্রয়িংরুম থাকবে। দামি দামি রুচিসম্মত সোফাসেট থাকবে। বিভিন্ন আকর্ষণীয় শোপিসে ভরপুর থাকবে রুমটি। একটি রুম থাকবে মেহমানদের জন্য। অন্য একটি রুম হবে তার নিজের। সে রুমটাও নিজের মত করে সাজানো থাকবে।
নিশাতের মা-বাবা গ্রামে থাকেন। গ্রামে নিশাতদের অনেক বড় বাড়ি রয়েছে। দুই ভাই এক বোনের নিশাতদের সংসার। অনেক চেষ্টা করেও নিশাত তার মা-বাবাকে ধানমন্ডির বাসায় আনতে পারেনি। হুম, আসে যখন চিকিৎসার প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে হয়। এতে নিশাতের কোন কষ্ট নেই। নেই কোন অভিযোগ নিশাতের মায়ের কিংবা বাবার।
ইদানীং বাড়ির জন্য মন খারাপ হলেও নিশাত চুপচাপ বসে থাকে। কল দিতে ইচ্ছে করেনা। কল দিলেই বাবা-মায়ের সাথে কথার মাঝখানে বা শেষে একটা টফিক বার বার আসছে বিয়ে কর, বিয়ে কর। নিশাতের বিয়ে শব্দটার প্রতি একটা অদ্ভুত রকমের ক্লান্তি আছে। ইচ্ছে করে এই শব্দটা এড়িয়ে যেতে। সে চাই আপাতত বিয়েটা নিয়ে না ভাবতে। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে ব্যপারটা এমনও না যে কখনোই বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। বিয়ে হবে তার আগে প্রেম হবে। মনের মত একজন মানুষের সাথে। যার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবেনা।শুধুমাত্র ঝগড়া দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে অভিযোগ সৃষ্টি করবে সে নিজে।
স্কুলে থাকতে ঠিক এরকম একটা ছেলেকে নিশাতের ভাল লাগত। ছেলেটা ভীষণ লাজুক ছিল। কোন মেয়ের সাথে কথা বলতনা। মেয়েরা তার সাথে কথা বললেও সে হুম অথবা না শব্দ দুটো দিয়ে কথা শেষ করত। পুরো ক্লাসের মেয়েদের আন অফিশিয়াল ক্রাশ ছিল সে। ছেলেটার নাম সাদমান। টিনা, রিনা, হোসনা, চৈতি, মিথিলা, জেসমিন, রুপারা সবাই সাদমানের প্রেমে হাবুডুবু খেত। সাথে নিশাত তো আছেই। কিন্তু নিশাতের ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারতোনা।
সাদমানের আহামরি কোন গুণাবলি ছিলনা। সে ভদ্র ছিল। মেধাবী ছিল। তার সবচেয়ে বড় গুণাবলী ছিল সে সৎ। মেয়েরা সৎ ছেলেদের প্রতি ভীষণ রকমের ক্রাশ অনুভব করে।
ক্লাস টেনের কথা। নিশাতরা পহেলা বৈশাখের দিন স্কুল ফাংশানে সবাই শাড়ি পরে এসেছে। ছেলেরা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। নিশাত মনে মনে সাদমানের কথা ভাবছিল। কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছিলোনা। নিশাতের মন খারাপ হয়ে গেল।সে ভেবেছিল শাড়ি পরে একবার সাদমানের সামনে যাবে।কথা বলবে। বুঝানোর চেষ্টা করবে সে তাকে পছন্দ করে।একটু পর সাদমান এসেছে। সে শার্ট পরেছে। সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সাদমানকে দেখে নিশাত ফিকফিক করে হেসে দিলো। সবাই একবার নিশাতের দিকে একবার সাদমানের দিকে তাকাচ্ছে। বেচারা সাদমান লজ্জা পেয়ে চলে গেল। সেদিনের পর থেকে সাদমান আর কখনো নিশাতের সামনে পড়েনি।
স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি শেষে দুজন এখন চাকরি ও করছে।নিশাত তার ফেইক আইডি থেকে সাদমান কে ফলো করে রেখেছে। তার সব পোষ্ট মন দিয়ে পড়ে। সব ছবি সেইভ করে রাখে। রাতে ঘুমানোর আগে এক নাগাড়ে ঘন্টাখানেক সাদমানের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে।অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে সাদমান কে নক দিতে। কথা বলতে।
‘করোনা’র জন্য চারদিকে লকডাউন। নিশাতের অফিসের কাজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাসায় বসেই করতে হচ্ছে। কয়েকদিন ধরে নিশাতের বেলকনি থেকে বার বার রাস্তা দেখতে ভাল লাগছে। খুব ইচ্ছে করছে ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে। অন্যকোনো সময় ঢাকার রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।
পহেলা বৈশাখের সকাল। প্রতিটা বৈশাখে স্কুলের ঘটনাটা খুব মনে পরে নিশাতের। এবারেও পড়ছে। খুব হাসি আসে ভাবলে। বেচারা সাদমানের জন্য মায়া হয়। হঠাৎ নিশাতের সাদমানকে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। সাথে সাথে নিশাত ফেসবুকে লগইন করলো। সাদমান স্ট্যাটাস দিয়েছে “মিসিং সামওয়ান স্ট্রংলি”
স্ট্যাটাসটা পড়ে নিশাতের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল।সাদমান কি কারো সাথে প্রেম করছে? কেন সে কাউকে শুধু শুধু মিস করবে। সত্যি সত্যি অন্যকোনো মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছেনা তো? করোনার ক্রান্তি শেষ হলে হয়তো সামনে তারা বিয়েও করবে। তখন আমার কী হবে?এতদিন যে ভালবেসে যাচ্ছি তার কাছে সেসবের কোন মূল্যায়ন হবেনা? নাহ আর পারছেনা নিশাত। মাথাটা ঘুরছে। কী করবে মাথায় খেলছেনা। সরাসরি সাদমানকেই জিজ্ঞেস করতে হবে মেয়েটা কে?
যেই ভাবনা সেই কাজ। নিশাত তার ফেইক আইডি থেকে প্রথমবারের মত সাদমানকে নক দিলো। বলল,মেয়েটা কে? সাদমান ও সাথে সাথে রিপ্লে দিলো, কোন মেয়েটা?নিশাত বলল, যাকে স্ট্রংলি মিস করছেন!
সাদমান বলল, আছে একজন। নিশাত রেগে গিয়ে বলল, কে সে? সাদমান বলল, আপনি চিনবেন না। নিশাত বলল, বলবেন না তাই তো?
সাদমান বলল, না। নিশাত বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।বলতে হবেনা। নিশাতের মেজাজটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে সাদমান কে সামনাসামনি গিয়ে জোরে একটা থাপ্পড় দিতে। আপাতত তা সম্ভব হবেনা।
একটুপর মেসেজের শব্দ হলো। নিশাত তাড়াতাড়ি ইনবক্স খুলে সাদমানের মেসেজ দেখতে পেল। সাদমান লিখেছে, নিশাত কেমন আছো? আমি জানি এটা তোমার ফেইক আইডি। দীর্ঘ বারো বছর ধরে তুমি আমার সব কিছু ফলো করছো। আমার খুঁজ নাও। এক কথায় সবকিছুতেই গোয়েন্দাগিরি করো। এবার শোন, আমি তোমাকে ফলো করি পনেরো বছর আগে থেকে। যখন আমরা ক্লাস এইটে পড়তাম। সবসময়ই তুমি ছিলে হৃদয় জুড়ে। স্ট্যাটাসটা তোমাকে নিয়েই দিয়েছি। জানি তুমি সব দেখো। এটাও দেখবে। জানতাম দেখে হিংসা হবে। এটা জানতাম না সরাসরি নক দিবে।
এই মূহুর্তে নিশাতের খুব সাজতে ইচ্ছে করছে। ঠিক যেভাবে সেবার স্কুলে সেজেছিল। সাদমানের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে। জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলতে ইচ্ছে করছে এত লাজুক কেন তুমি? জীবন থেকে পনেরো টা বছর এভাবে দূরে সরিয়ে রাখলে আমায়! তুমি খুব পঁচা।তোমাকে আমি খুব খুব ঘৃণা করি!
রামু, কক্সবাজার।
Leave a Reply