আলম তৌহিদ
কক্সবাজার নামের ইতিহাস প্রায় দুই শত বছর পার হয়ে গেল। এই শহরের গোঁড়াপত্তনের পূর্বে এর কয়েকটি আকর্ষণীয় নাম ছিল। রাখাইনরা এই অঞ্চলকে বলত প্যাঁওয়া, যার অর্থ হলুদ ফুলের দেশ। তাছাড়া বাঁকোলী, ফালংক্যি বা পালঙ্কি নামেরও প্রচার ছিল। ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক জেলা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কক্সবাজার চট্টগ্রাম জেলার অধীনস্ত মহকুমা ছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সাথে তাল মিলিয়ে এই অঞ্চলে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তেমন উল্লেখযোগ্য গতিধারা সৃষ্টি হয় নি।
কবি নসরুল্লাহ খোন্দাকার ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কক্সবাজারে আরও কয়েকজন কবি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কবি নেয়াজ, শেখ মনসুর, আবদুল আলী, মুজিবুল্লাহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নসরুল্লাহ খোন্দাকার ছিলেন রামুর অধিবাসী। তিনি ‘জঙ্গনামা’, ‘মুসার সওয়াল’, ‘শরিয়তনামা’ ও ‘হিদায়তুল ইসলাম’ নামে ৪টি কাব্য রচনা করেন। তাঁর রচনাকর্ম থেকে তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। তাঁর পিতার নাম শরীফ মনসুর খোন্দকার। কাজী ইসহাক খান ছিলেন তাঁর পিতামহ। তাদের পূর্বপুরুষ হামিদুদ্দীন খাঁ ছিলেন গৌড় রাজার সৈন্যপাল উজির। তৎকালীন রামুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায় নসরুল্লাহ খোন্দাকারের রচনা থেকে। ড.আব্দুল করিমের মতে, নসরুল্লাহ সপ্তদশ শতকের শেষপদ থেকে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
“উনিশ শতকে দ্বিতীয় দশকে রামু থানার মিটাছড়ির জনাব আলী হোসেন চৌধুরীর পৃষ্টপোষকতায় যে কয়েকজন কবি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁরা হলেন কবি তমিজি, কবি হাজী আলী, ফকির আসগর আলী ও লোকমান আলী।” (কক্সবাজারের ইতিহাস- অধ্যাপক নূর আহমদ এডভোকেট)’পঞ্চসতী প্যারেজান’ পুঁথির রচয়িতা হলেন ফকির আসগর আলী। ‘মওতনামা’ পুঁথির লেখক হাজী আলী। তাঁর পুঁথিটি ছিল খণ্ডিত। এর সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায় নি। লোকমান আলীর পুঁথিটিও খণ্ডিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এটির নামও ছিল না। ‘হাদিস কালাম বাণী’ নামটি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের দেয়া। কবি তমিজির দুটি কাব্য হলো যথাক্রমে ‘লালমতি’ ও ‘তাজুল মুলুক’।
আলহাজ্ব আমির মোহাম্মদ সিকদার ছিলেন বিশ শতকের কবি। তিনি ১৯৩১ সালের দিকে রচনা করেন ‘আদর্শ হেজাজ ভ্রমণ’ নামে একটি ব্যাতিক্রমধর্মী কাব্য। প্রচারের অভাবে তিনি অনেকটা ইতিহাসের আড়ালে থেকে গেছেন। নূরুল ইসলাম সম্পাদিত ”কক্সবাজারের কবিতা” গ্রন্থে মুল্যায়িত হওয়া ছাড়া অন্যান্য গবেষকদের কাছে তিনি উপেক্ষিত থেকে গেছেন। তরুণ গবেষক কালাম আজাদ ২০০৮ সালের দিকে তাঁর গ্রন্থের উপর একটি রিভিউ লিখেছিলেন স্থানিয় দৈনিকে।
রামু উপজেলার অন্তর্গত ধলিরছড়া একটি গ্রামীণ জনপদ (রশিদ নগর ইউনিয়ন)। পাহাড়, খাল, মাঠভরা সাদা লবণ, চিংড়ি ও সবুজ-সোনালী ধানের আঘ্রাণে ভরপুর এই সমৃদ্ধ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৬৫ সালে আমির মোহাম্মদ সিকদার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ মাগন আলী সিকদার ধর্মানুরাগী, সমাজসেবী ও সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। মাগন আলীর পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ উমেদ আলী সিকদার। কবি আমির মোহাম্মদ সিকদারের পূর্বপুরুষগণ চট্টগ্রামের গহিরা থেকে অত্র অঞ্চলে আগমন করেন বলে জানা যায়। তারা আরব বণিকদের বংশোদ্ভুত বলে দাবী করতেন।
আমির মোহাম্মদ সিকদারের প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে আরও দশ গ্রামে ছাড়িয়ে পড়ে। স্বভাবে বিনয়ী, ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠার কারণে তিনি সর্বমহলে প্রশংসিত ছিলেন। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন এবং নিষ্ঠার সাথে ধর্মপালন করতেন। ঈদ্গাঁও, ঈদগড় ও ধালিরছড়ায় তিনি প্রচুর ভূ-সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কাব্যচর্চার পাশাপাশি তিনি প্রচুর জনহিতকর কাজও করেছেন। রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুকুর খনন, মক্তব ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। তিনি ছিলেন ঈদগাঁও বাজার জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা এবং মসজিদটি পরিচালন ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য জমিও দান করেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন দানবীর। জনশ্রুতি আছে যে, এক দরিদ্র চাষা এক হাঁড়ি দই উপহার দিয়ে নিজের দুঃখ-দুর্দশা ও দারিদ্র্যের কথা বর্ণনা করলে, তৎক্ষনাৎ তিনি সেই চাষাকে ৬ কানি জমির খাজনা মওকুব করে দিয়েছিলেন। তিনি গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের আর্থিক সাহায্যও প্রদান করতেন।
আমির মোহাম্মদের পিতামহ মোহাম্মদ উমেদ আলী সিকদার ছিলেন সিকদার বংশের আদিপুরুষ। উমেদ আলীরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাদের এক ভাই ঈদগড়ে এবং আরেক ভাই পিএম খালির তুতক খালী গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। উমেদ আলী সিকদারের ঔরশে জন্ম হয় তিনজন পুত্র। তারা হলেন যথাক্রমে- ১। ফকির মোহাম্মদ সিকদার ২। মোহাম্মদ মাগন আলী সিকদার ৩। মোহাম্মদ দাসি সিকদার।
মোহাম্মদ মাগন আলী সিকদারের ঔরশ থেকে জন্ম নেন যথাক্রমে-মোহাম্মদ কালো সিকদার (১৮৪৫-১৯২৮), আমির মোহাম্মদ সিকদার (১৮৬৫-১৯৬৬) ও মোহাম্মদ আজম সিকদার (১৮৮০-১৯৫০)। মোহাম্মদ মাগন আলী সিকদারের তিন পুত্রের মধ্যে আমির মোহাম্মদ সিকদার ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন ৭ পুত্র ও ১১ কন্যা। পুত্রগণ হলেন যথাক্রমে- ১। তমিজ উদ্দিন সিকদার(মৃত) ২। ছিদ্দিক আহমেদ (মৃত) ৩। নবাব মিয়া (মৃত) ৪। মমতাজ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (মৃত) ৫। ইমতিয়াজ আহমদ চৌধুরী ৬। অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী ৭। ফেরদৌস আহমেদ চৌধুরী। আমির মোহাম্মদ সিকদারের ঔরশজাত কন্যাগণ হলেন যথাক্রমে- ১।মায়মুনা বেগম ২। আমেনা বেগম ৩। জরিনা বেগম ৪। হাফেজা বেগম ৫। গুলবদন বেগম ৬। ছমুদা বেগম ৭। রোকােইয়া বেগম ৮। সুখিয়া বেগম ৯। ফরমোজা বেগম ১০। ফরিদা বেগম ১১। নূর জাহান বেগম।
আমির মোহাম্মদ সিকদারের পক্ষে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করা সম্ভব হয়নি। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। বিভিন্ন ওলেমা কেরামদের সহায়তায় বাংলা ও আরবী ভাষা সম্পর্কে তিনি প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ঈদগাঁও আলমাসিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধক্ষ্য হযরত মাওলানা আবদুল আজিজের সান্নিধ্য লাভ করেন। এই সাহচার্য তাঁর পাণ্ডিত্যকে আরও শাণিত করে।
১৯৩১ সালে তিনি হজব্রত পালন করেন। হজব্রতের উদ্দেশ্যে গমন ও পালনের অভিজ্ঞতাকে উপজীব্য করে তিনি রচনা করেন ‘আদর্শ হেজাজ ভ্রমণ’ নামে এক চমকপ্রদ কাব্য। গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র আলহাজ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। গ্রন্থ প্রকাশে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন কবির সুযোগ্য নাতি আলহাজ্ব বদিউল আলাম (সাংবাদিক)। গ্রন্থটি পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত হয়। ১৯৬৬ সালে আমির মোহাম্মদ সিকদার ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ‘দীন দুনিয়া’ নামে আরও একটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু এটি এত জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় ছিল যে পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।
আদর্শ হেজাজ ভ্রমণ’ কাব্য নিয়ে আলোচনার শুরুতেই নজর কাড়ে এর নামকরণ। প্রকরণের সাথে গ্রন্থের নামের সম্বন্ধ না থাকলে সেই নাম যথার্ত হয়না। ‘আদর্শ’ বলতে শ্রেষ্ঠ বিষয়, দৃষ্টান্ত বা অনুসরণযোগ্য বুঝায়। ‘হেজাজ’ আরবদেশের প্রাচীন নাম, আর ‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ভ্রমণ’। অতঃএব কাব্যের নাম ‘আদর্শ হেজাজ ভ্রমণ’ কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে চয়ন করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। কাব্যটি একরৈখিক নয়, বরং এর রয়েছ বহুবিধ ব্যঞ্জনা। এই কাব্যে তিরিশ দশকের যোগাযোগ ব্যবস্থা, কবির সফরসঙ্গী হিসেবে অত্র অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কথা, হজব্রত পালনের নিয়মাবলী, মক্কা-মদীনা শরীফের পরিচিতি, বায়তুল্লাহ সৃষ্টির রহস্য, আরাফাতের বয়ান, ছফা-মরওয়ার গূঢ় তথ্য ছাড়াও আরও অনেক বিষয়ের সন্নিবেশ দেখা যায়। গ্রন্থটি হজ পালনকারীদের জন্য একটি সহায়ক গাইড হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
আমির মোহাম্মদ সিকদারের সফরসঙ্গী হিসেবে অত্র অঞ্চলের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কথা জানা যায়। ‘রৌনা’ কবিতায় এর উল্লেখ আছে। ‘রৌনা’ শব্দের অর্থ রওয়ানা বা যাত্রা করা। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন রাজারকুল গ্রামের মৌলভী আমিন উল্লাহ এবং তার দুইজন ভ্রাতুষ্পুত্র হাফেজ মখলজ্জমান ও সিকদার আশরফজ্জমান। কক্সবাজার শহরের এক মৌলভীর কথাও জানা যায়, তার নাম আবদুল কুদ্দুছ। পানিরছড়া গ্রামের মৌলভী আলী আকবর ও ঈদগড় নিবাসী সিকদার নছরত আলীও তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে আরও ছিলেন ঈদগাও নিবাসী ফর্ত্তা বলী। এই কবিতা থেকে তিনি সহ মোট অষ্টাদশ হাজীর হেজাজ ভ্রমণের কথা জানা যায়। এই দীর্ঘ কবিতাতে ভ্রমণের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন। কীভাবে জাহাজে আরোহণ করলেন, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হওয়া, লাকসাম-চাঁদপুর অতিক্রম করে পদ্মানদীর মনোরম শোভা দেখতে দেখতে গোয়ালন্দ পৌঁছার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। ই বি আর গাড়িতে করে কলকাতায় উপনীত হওয়া এবং দৃষ্টিনন্দন হাওড়া ব্রীজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। অতঃপর বোম্বাই (মোম্বাই) নগরে পৌঁছলে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা সাতটি সুড়ঙ্গযুক্ত পাহাড় দেখে চমৎকৃত হলেন, যে সুড়ঙ্গপথে গাড়ি চলাচল করে। তখন পাহাড় ধ্বসে পড়ার আশংকাও তাঁদের মনে উদিত হয়েছিল।
জাহাজ যখন গভীর সমুদ্র পাড়ি দেয়, তখন চতুর্দিকে অথৈ জলরাশি ছাড়া কোনো কুল-কিনারা দেখা যায়না। অনেক সময় দিকনির্ণয়ে সমস্যা দেখা দেয়; বিশেষ করে রাতের বেলা সমস্যা হয় আরও প্রকট। আমির মোহাম্মদ তেমন এক পরিস্থিতি চিত্রিত করেন দুটি পঙতিতে।
স্বর্গ থেকে উঠে ভানু স্বর্গে ডুবি যায়।
দিগ নির্ণয় নাই কোথায় চলি যায়।।
আমির মোহাম্মদ যেমন ছিলেন আধ্যাত্মবাদী, আবার তাঁর জীবনোপলব্ধি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে উৎসারিত। ‘উর্দ্দু গজল’ কবিতায় তিনি মানুষকে সদুপোদেশ ও মৃত্যু সম্পর্কে সতর্ক করছেন, যেন তারা সঠিক সময়ে উত্তম কাজটি করে। রূপক ও ছন্দের চমৎকার বিন্যাসে তাঁর জীবন-দর্শনের প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায়। তিনি লিখেন-
“সময় বহিয়া যায় যেন সমীরণ।
বুঝি সুঝি কাজ কর থাকিতে জীবন।।
হৃদয় পিঞ্জরে তুমি পোষেছ বিহঙ্গ।
তার সঙ্গে করিতেছ হাসিখুশি রঙ্গ।।”
এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে লালন এসে পড়ে। তবে এটি কোনো তুলনা নয়। লালন ছিলেন সাধক পুরুষ। তাঁর দর্শনের সাথে আমির মোহাম্মদের চিন্তা-চেতনার বিন্দু-বিসর্গ মিল নেই। আমাদের কথা হলো লালনের ‘খাঁচা’ ও ‘অচিন পাখি’ নিয়ে। লালন ‘খাঁচা’ বলতে মানবদেহ এবং ‘অচিন পাখি’ বলতে প্রাণবায়ুকে বুঝিয়েছেন। মানবদেহে কীভাবে প্রাণ আসে, আবার কীভাবে তিরোহিত হয়, অর্থাৎ মানুষের জন্মমৃত্যু নিয়ে তাঁর গভীর ভাবনা অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচায়ক। উদ্ধৃত কবিতাংশে ‘পিঞ্জর’ মানবদেহ নয়, আমির মোহাম্মদ হৃদয়কে পিঞ্জর রূপকে প্রকাশ করেছেন, আর তাঁর ‘বিহঙ্গ’ শব্দটি প্রাণ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। এটি ধন-দৌলত-প্রাচুর্যের রূপক মাত্র। লালন ও আমির মোহাম্মদের রূপকের উপাদানগত মিল থাকলেও, উভয়ের প্রয়োগ কৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থগত ভিন্নতা সুস্পষ্ট। এখানেই আমির মোহাম্মদের বিশিষ্টতা এবং তাঁর প্রজ্ঞা ও কবি প্রতিভার ছাপ উৎকীর্ণ হয়ে উঠে। শব্দ কবিতার অপরিহার্য উপাদান। শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগ কৌশলে কবি যথেষ্ট সচেতন না হলে, কবিতা দুর্বল হতে বাধ্য। আমির মোহাম্মদের মধ্যেও দেখতে পাই প্রভূত শব্দজ্ঞান। তাঁর প্রয়োগ দক্ষতাও অনন্য। তাঁর কবিতায় আরবী, ফারসি, তদ্ভব ও তৎসম শব্দের সফল প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন- “আজীম/মিন্নতি/লাবণ্য/হিয়া/লামোকাম/অনাহুত/ইয়ত্তা/ইলেক /লবেলজ্জা/জাহ্নবী/মকরন্দ/ভৃঙ্গ/নফসী/দুস্তিদার /বখিল/গোলজার/শশধর/রুওয়া/একিন/নিরঞ্জন/ভানু/জাহের/হরষিত/গাফেলাত/বেওফা/পাকিজা/ আজেজ/মোহসিন।”
আমির মোহাম্মদের বোধে-চিন্তনে রয়েছে সুন্দরের প্রতি অনুরাগ। তাঁর কবিতার শব্দে-পঙতিতে রয়েছে লাবণ্যের সতেজ আবরণ। রূপক ও ছন্দে তিনি অসাধারণ। অনুপ্রাস সৃষ্টিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর কবিতা থেকে কয়েকটি বাছাইকৃত পঙতি দৃষ্টান্ত হিসেবে মান্য-
নিগূঢ় নিজস্ব নির্প নিদ্রাহীন কায়া।
রচিয়া রঙ্গ ভুবন নিজে গুপ্তে ছায়া।।
“মন মকরন্দ মন মঞ্জরীর ভৃঙ্গ।
মস্তক মুরাদ মীম কলেবর শৃঙ্গ।।”
>৩। “তুমিত ঈশ্বর, আমিত কিঙ্কর, ইচ্ছামতে দুঃখ সুখ,
নিজ্জ্য অংশে দানে, সৃজিলা জাহানে, তব প্রেমে পুড়ি বুক।”
৪। “বেওফা নির্দয় জন সেই যমদূত।
বিগঠ বরণ তাঁর দেখিতে অদ্ভূত।।”
৫। “স্বর্গপুরী-তুল্য দেখি দিল্লী রাজঘর।
প্রবেশিতে নারি, দুঃখী হইল অন্তর।।”
‘আদর্শ হেজাজ ভ্রমণ’ কাব্যে কবিতার পাশাপাশি আরবী ভাষায় লিখিত দোয়া, হজের নিয়ত, তওয়াফ করার নিয়ম, সেগুলোর বঙ্গানুবাদ, হজের আরকাম-আহকাম ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রচলিত কাব্য-কাঠামো এখানে রক্ষিত হয়নি। আমির মোহাম্মদ স্থিরকৃত কাঠামো ভেঙ্গে এক নতুন পথের অভিযাত্রী হয়েছেন। মূলত এই গ্রন্থ রচনায় তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত, মনের সুপ্তকথা ব্যক্ত করার অভিপ্রায়ে কবিতার কাছে আশ্রয় নেয়া। দ্বিতীয়ত, পাঠককে হজব্রত পালনের নিয়মাবলী অবহিত করা। গ্রন্থ বিচারে কবি আমির মোহাম্মদ সিকদারের সফলতা অনস্বীকার্য।
লেখক : কবি-গল্পকার ও সাহিত্য সমালোচক
Leave a Reply