আলম তৌহিদ
পৃথিবী হচ্ছে সৃষ্টিশীল গ্রহ। বিশেষ করে প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী গ্রহ। প্রাণ সৃষ্টির জন্য যে কয়টি মৌলিক উপাদান দরকার তার সবকটি পৃথিবীতে বিদ্যমান। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ যেমন প্রাণী তেমনি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসও প্রাণ, যদিও এদের অণুজীব বলা যাবে কিনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। এসব ক্ষতিকর জীবাণু মানব দেহে প্রবেশ করে রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি করে। এমন কি অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু মানুষের জন্য ক্ষতিকারক তা নয়, পশুপাখির জন্যও এরা ক্ষতিকারক। তবে উপকারি ব্যাকটেরিয়াও আছে। যেমন দধিতে থাকে এমন ব্যাকটেরিয়া।
অনেক সময় এসব জীবাণু মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন মানবসমাজে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি একসময় প্লেগ নামক রোগটি পৃথিবীতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। প্লেগ হল ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। প্রায় ৩০০০ হাজার বছর পূর্বে এই রোগটির অস্তিত্ব প্রথম জানা যায়। প্লেগ ইঁদুর থেকে মানব দেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্লেগকে ভারতীয়রা বলত মহামারী। ভগবত গীতায় (১৫০০-৮০০ খৃষ্টপূর্ব) এর উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঐ ঘর তারা দ্রুত পরিত্যাগ করত যেখানে ইঁদুর মরে পড়ে থাকত। খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। মধ্য এশিয়া, ভারত ও চীনে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। ১৬৬৪-৬৫ সাল পর্যন্ত প্লেগ লন্ডনে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে মাঝেমধ্যে এই রোগের আবির্ভাব হত।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৮১৫ খৃষ্টাব্দে প্লেগ গুজরাট, কাথিওয়ার ও কুচ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে হায়দারাবাদ, আহমেদাবাদ ও ধলেরা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে রাজপুতনার পালি শহরে এবং পরে আজমীর-মারওয়াতে এই রোগের বিস্তৃতি ঘটে। এরপর বেশ কিছু বছর প্লেগের সংক্রমণ না ঘটলেও ১৮৪৯-৫০ এবং ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে আবার প্লেগ ভয়াবহ ভাবে দক্ষিণ ভারতে বিস্তার লাভ করে। ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৮৯৬-১৯১৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে প্লেগের কারণে মৃতের সংখ্যা ছিল ৯৩ লাখ ১৫ হাজার ৮ শত ৯২ জন। ঐতিহাসিকদের মতে, প্লেগ মহামারীতে সারা পৃথিবীতে ২০০ বছরে প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
কলেরা আর একটি ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির নাম। ইউরোপীয়রা বলত এশিয় কলেরা। এটিও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। আক্রান্ত ব্যাক্তির মল থেকে এই রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটে। একসময় ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। তৎকালীন বঙ্গে এই রোগকে বলা হত ওলাওঠা। এই রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য হিন্দুরা ওলাইচণ্ডী দেবীর পূজা করত। মুসলমানদের কাছে এই দেবী ওলাবিবি নামে পরিচিত ছিল। ওলাইচণ্ডী হলেন হিন্দুদের লৌকিক দেবী। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে এই দেবী বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দের দিকে কলেরা পৃথিবীতে মহামারীর রূপ নেয়। এইসময়ে রাশিয়া ভারত ও চীনে প্রায় ৪ কোটি মানুষ মারা যায়। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই রোগের ভয়াবহতা ছিল মারাত্মক।
রাশান বংশোদ্ভুত ইহুদী বিজ্ঞানী ওয়াল্ডিমার হাভকিন প্লেগ ও কলেরার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে মানবজাতিকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর নামে ডাক টিকেট ছাপিয়েছিল। ম্যালেরিয়া, যক্ষা, গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা, সার্স, এইডস, ইয়েলো ফিভার প্রভৃতি মরণঘাতী ব্যাধিতে সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সম্প্রতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া রোগটির নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ । এটির প্রথম আবির্ভাব ঘটে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। এখান থেকেই এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাস এখন আতঙ্কের নাম। এই ভাইরাসটি করোনাভাইরাস নামক প্যাথোজেন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সার্স ও মার্স ভাইরাসও একই পরিবারভুক্ত। সার্স ভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ছিল ৯% এবং মার্সে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল ৩৫% । তবে বর্তমানে করোনা ভাইরাস এদের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এটি এখন বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ব এখন সরগরম করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি বিতর্ক নিয়ে। হঠাৎ এই ভাইরাসটি কোথা থেকে এলো এবং এর ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সমানে চলছেই। এই ভাইরাসের মারণ থাবায় সাধারণ মানুষ তো মরছেই, এমকি রেহায় পাচ্ছেনা সেবা প্রদানকারী ডাক্তার-নার্সরাও। এই ভাইরাস কি প্রকৃতিজাত, নাকি ল্যাবরেটরিতে তৈরি মরণঘাতী জীবাণু অস্ত্র? শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন চীনের দিকে। তিনি বলেন করোনা ভাইরাস চীনের তৈরি জীবাণু অস্ত্র। উহানের ল্যাবরেটরিতে এটি তৈরি করা হয়েছে। ইসরাইলও যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে বলেন চীনই এই ভাইরাস তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের আদালতে চীনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
চীন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে প্রথম করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লেও চীনা বিজ্ঞানীদের দাবী এই ভাইরাসের উৎপত্তি স্থল চীন নয়। বরং তাদের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। তারা দাবী করেন, গেল বছর অক্টোবরে উহানে মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেমস প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আশা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি দল কভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা কোনো প্রাণীদেহ থেকে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, আর সেই প্রাণীটি হচ্ছে বাদুড়। করোনা ভাইরাস যে কতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা নিচে দেয়া পরিসংখ্যানের তালিকা থেকে উপলব্ধি করা যাবে। পরিসংখ্যান তালিকাটি নেয়া হয়েছে ওয়ার্ল্ড মিটার (www.worldometers.info) থেকে।
দেশ | আক্রান্ত | মৃত্যু | সুস্থ |
বিশ্ব | ২৯২৪২৬৫ | ২০৩৩২৪ | ৮,৩৭,৭২১ |
বাংলাদেশ | ৫,৪১৬ | ১৪৫ | ১২২ |
আলম তৌহিদ : কবি ও প্রাবন্ধিক
Leave a Reply