সিন্টু চৌধুরী
কি যে করে রেখেছো রান্নাঘরটাকে। এতো এতো থালা বাটি চামচ কাটা-চামচ কে ধোবে? কি যে করো সারাদিন! কোথায় আমার কাজ কমাবে তা না করে উল্টো কাজ বাড়িয়ে বেড়াচ্ছো।
ছোটো বাচ্চাটার চেয়ে বাচ্চা হয়ে গেছো! কেনো যে তোমার অফিস খোলে না আল্লাহ মালুম! রিনা চিৎকার করছে আর অন্যদিকে একমাত্র ছেলে, ওয়ানে পড়ুয়া কাব্যকে নিয়ে ক্রিকেট খেলায় মত্ত মানিক । মানিক সাহেব ব্যস্ত কর্পোরেট কর্মকর্তা। একটি রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। সারাজীবন দুই ভাগে বিভক্ত, ছাত্রজীবন ও কর্মজীবন। এতোটা অবসর কোনো জীবনেই মিলেনি মানিকের। আর বাকি দশটা ছাত্রের মতো তার দিন কাটেনি। বাবা গত হয়েছেন যখন তিনি ক্লাস সিক্সে পড়েন। একর তিনেক চাষ যোগ্য জমি। এই জমিতে চাষ করা, প্রাইভেট পড়া নামক বিলাসিতা মনেই আসেনি। মা-ছোট বোন জান্নাতসহ দিন রাতের খাটুনি খেটে ফসল জমিয়ে রাখা। প্রয়োজনে বিক্রি করে অন্যান্য খরচ মিটানো। দুজনের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নেয়া। এসএসসি পরীক্ষায় বেশ ভালো ফলাফল করেও গ্রামের মোটামুটি মানের কলেজে পড়া এবং এইচএসসি পরীক্ষায় আবারও ভালো ফলাফল।তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে। চাকরি জীবন। মাঝারি পর্যায়ের পদ দিয়ে শুরু। অল্প ক’দিনেই উচ্চতর পদে পৌঁছে গেছে শুধুমাত্র পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার জোরে। অখন্ড অবসরের আবদার মা ও স্ত্রী প্রায়ই চাইত এখন পেয়ে। কখনো বাপবেটা মিলে রান্না করা, ক্রিকেট খেলা, স্ত্রীর সাথে খুনসুটি, মায়ের সাথে বসে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বোনের পিছু নিয়ে খেপানো সবই চলছে কিন্তু সময় ফুরাতে চায় না। এতটা অবসর! রিনা, তৃষ্ণা পেয়েছে। আবার এক গ্লাস গরম পানি কি পাবো, ম্যাম। একটু আগেই তো দিলাম এখনো একঘন্টা পর হয়নি। তুমি বলতে চেয়েছো পাবো না, তাইনা? না, পাবে না। কাব্য! এই দিকে এসো। আমাদের রান্না অভিযান আবার শুরু করতে হবে। বাবা চায়ের সাথে তোমার কি চায়? মনোযোগী সহযোদ্ধার সহজ উত্তর- বোম্বাই টোস্ট, বাবা। তো ফ্রিজ খোল ডিম আনো, পাউরুটি, পিঁয়াজ, কাঁচা মরি ….
কথা শেষ হবার আগেই রিনার চিৎকার ‘আম্মা, আপনি আপনার ছেলেকে সামলান আমি আমারটাকে সামলাবো”।
কথাটি শুনেই ফিক করে হেসে সুফিয়া বেগম কপট রাগে ডাক দিলেন “মানিক তোমার রান্না ঘরে যাওয়া হবে না, তুমি আমার কাছে এসো। কাব্য বন্ধুকে ছেড়ে মায়ের কাছে যাও। বৌমা দুটো সামলে দিলাম।” আম্মা আপনিও! রাগতে গিয়েও হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো শাশুড়ির কাছে, জড়িয়ে ধরল। আচ্ছা মা দিচ্ছি কিন্তু সন্ধ্যার আগে আর পাবে না। রিনা অবাক হয়ে ভাবে একজন গেঁয়ো অর্ধশিক্ষিত মহিলা কত সহজে সব সমস্যার সমাধান করেন। আজও ভাবতে অবাক লাগে এই মহিলা কত্ত সহজে পুত্রবধূ হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন! সেদিন মামাতো বোনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যাচ্ছিলো। পাশের সিটে জান্নাতকে নিয়ে বসেছিলেন। কোন স্টেশন থেকে উঠেছিলেন খেয়াল করা হয়নি। ছেলে অফিসের কাজে দেশের বাইরে তাই মেয়েকে নিয়ে তিনি এসেছেন হলে পৌঁছে দিতে। বাড়ি কক্সবাজার। রিনা গভীরভাবে দেখলো মেয়েটিও গেঁয়ো গেঁয়ো, তবে কেমন যেন আকর্ষনীয়। কথা বলতে ইচ্ছে করে। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত সপ্রতিভ। রিনাই জানতে চাইল “কোন ডিপার্টমেন্ট?” বায়কেমিস্ট্রি। ফার্স্ট ইয়ার। আপনি? ইংলিশ, থার্ড ইয়ার। এই যে ও আপনার সাথে বাংলা ডিপার্টমেন্ট। হলে সিট হয়নি এখনো আমার মামাতো বোন, আমার সাথে হলে থাকে। আপনি সায়েন্স ফেকাল্টিতে তাই সিট পেয়ে গেলেন। আপনি তো খুব দায়িত্বশীল মেয়ে। বিয়ে করার চিন্তা ভাবনা আছে নাকি বাদ দিয়েছেন!
রিনা অবাক হয়ে গেল তা বুঝতে পেরে বললেন “মানিক, আমার ছেলে বলে এখনকার লেখাপড়া জানা মেয়েরা বিয়ে করতে চায় না। অনেকে করে না। তাই এইভাবে বলা।
আলাপচারিতায় বাবার ফোন নম্বর নিলেন। বাবাকে ফোন করলেন। ছেলের ব্যাপারে খবর নিতে বললেন। খবরাখবর নেয়ার পর পছন্দ হলে কথা বলতে আসবেন।
বাবা খোঁজ খবর নিয়ে মাকে নিয়ে সোজা মানিকের বাসায় গেলেন। জামাল খান রোডের খাস্তগীর স্কুলের পাশের দালানের তিন তলায়। মায়ের ছেলে পছন্দ হয়েছে। আমাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলা হল। বিস্তারিত শোনে আমার মেজাজ সপ্তমে। কেনো মেয়ের পক্ষ হয়ে ওনাদের বাসায় আগে গেলো। পরে মা যখন জানালো, মানিকের মা-ই বলেছেন যে মেয়ে দেখতে গিয়ে বিয়ে না হলে লোকজন দোষ খোঁজে বেড়ায় তাই মেয়ের পক্ষের অগ্র যাত্রা। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনোভাবে পাত্রী দেখতে এলো না। আমাকে মা একটা মানিকের ছবি দিয়ে বলল “ তোর পছন্দ হলে তবে বিয়ে নয়তো নয়।”
চা মগে ঢালবে এমন সময় রিনার ফোন বেজে উঠল। হ্যালো, মা, কেমন আছো?
অন্য পাশের কথা শোনছিল শুধু রিনা, বাকিরা যা শুনছে। আমার কথা আর বলোনা মা। শাশুড়ির ছেলে আর আমার ছেলে বেশি জ্বালাচ্ছে। ভাবছি অফিস শুরু না হওয়া পর্যন্ত তোমার ওখানে থাকি। কি বলো? আসবো? কি বললে সবাইকে নিয়ে আসতাম! তাহলে ওখানে গিয়ে লাভ কি! এখানেই বেশ আছি। বেশ আছি। রাখছি মা। মানিককে চা দিব এখন। সাবধানে থেকো। (চলবে…)
লেখকঃ গল্পকার
Leave a Reply