আলম তৌহিদ
ফরাসি বিপ্লব এমন একটি ঘটনা যা বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল। বিশেষ করে ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতিতে এর প্রভাব পড়েছিল ব্যাপকভাবে।
ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি,কিন্তু সেই বিপ্লবে যে এক বাংলাদেশী ছেলে জড়িয়ে গিয়েছিল তা হয়ত অনেকে জানিনা।
তার নাম জামর। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে তিনি লুইস বেনোইট জামর নামে পরিচিত। তিনি ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জামর ছিলেন সিদ্দি বংশোদ্ভূত একজন ফরাসি বিপ্লবী। সিদ্দিরা ছিল পূর্ব আফ্রিকার বান্টু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আরব আর পর্তুগীজদের মাধ্যমে সিদ্দিরা দক্ষিণ এশিয়াতে এসেছিল। (সিদ্দিরা সিদ্ধি,শেদি বা হাবশি নামেও পরিচিত। বর্তমানে ভারত-পাকিস্তানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার সিদ্দি সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস রয়েছে। অধিকাংশ সিদ্দিরা মুসলমান, তবে তাদের মধ্যে সামান্য হিন্দু ও ক্যাথলিক খ্রিষ্টানও আছে।)
যতদূর জানা যায় জামরকে ১০ বা ১১ বছর বয়সে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ব্রিটিশ দাস ব্যবসায়ীরা অপহরণ করে। তাকে ক্রীতদাস হিসেবে প্রথমে মাদাগাস্কার নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে ফরাসি দাস ব্যবসায়িদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা জামরকে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইসের কাছে বিক্রি করেছিল। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে তার জীবন বদলে যায়। রাজা জামরকে তাঁর উপপত্নী জেনি ব্যাকু কমটেসি ডু ব্যারির কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। ডু ব্যারির ভাল লেগে যায় ছেলেটিকে। তিন তাকে উত্তম পোশাক পরিধান করিয়েছিলেন যাতে তাকে শোভন দেখায় এবং লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলেন। সাহিত্য সম্পর্কে জামর বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেন এবং রুশোর কর্ম তাকে খুব অনুপ্রাণিত করছিল।
ডু ব্যারির দিন শুরু হতো সকাল ৯টায়। তখন জামর তার জন্য এক কাপ চকোলেট নিয়ে আসতেন। ডু ব্যারি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ভুল ধারণা পোষণ করেছিলেন যে জামর আফ্রিকান। ঐ সময়ের রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায় যে জামর ছোটবেলায় অত্যন্ত দুষ্টপ্রকৃতির ছিল। ডু ব্যারি তার স্মৃতিকথায় লিখেন- “The second object of my regard was Zamor, a young African boy, full of intelligence and mischief; simple and independent in his nature, yet wild as his country. Zamor fancied himself the equal of all he met, scarcely deigning to acknowledge the king himself as his superior.”
ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে জামর ডু ব্যারির আরও এক গৃহকর্মীকে নিয়ে বিপ্লবীদের ক্লাব জেকোবিনে যোগ দিয়েছিলেন। জেকোবিন ফরাসি বিপ্লবের সময়ে একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক সংগঠন। এরপর জামর বিপ্লবী গ্রিভের অনুগামী ও সমর্থক হয়ে উঠলেন। তখন থেকে তিনি ডু ব্যারি এবং তার দুর্দান্ত জীবনযাত্রাকে অপছন্দ করতে শুরু করলেন। তিনি ডু ব্যারির হারানো গহনা পুনুরুদ্ধারের ব্যাপারে বারবার ইংল্যান্ড ভ্রমণের প্রতিবাদ করছিলেন এবং অভিজাতদের সুরক্ষা দেয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করছিলেন। এই অপরাধে তিন দিনের নোটিশে জামরের চাকুরিচ্যুতি ঘটে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে জামর বিপ্লবের পক্ষে আরও সোচ্চার ও উম্মুক্ত হয়ে উঠেন। জন সুরক্ষা কমিটির একজন সদস্য ও সংবাদ দাতা হিসেবে তিনি ১৭৯২ সালে ডু ব্যারিকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। ১৭৯৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ডু ব্যারির বিচারের সময় জামর তার বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন। বিচারে ডু ব্যারির মৃত্যুদণ্ড হয়। তার গৃহে পালিত বলে জামরেরও কারাদণ্ড হয়েছিল। তবে ৬ সপ্তাহ পরে তার সহযোদ্ধাদের সহায়তায় তিনি মুক্ত হন। বিচারে সাক্ষ্যদান কালে জামর উল্লেখ করেছিলেন তিনি আফ্রিকান নন, তার জন্মস্থান বাংলার চট্টগ্রামে।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জামর ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যান এবং নেপোলিয়নের পতনের পূর্বে তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে আসেন। তিনি ল্যাটিন কোয়ার্টারের কাছে রিউ মাট্রে আলবার্টে একটি বাড়ি কিনেছিলেন এবং ইস্কুল শিক্ষক হিসেবে সেখানে কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন। ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় জামর মৃত্যুবরণ করেন। তাকে প্যারিসে সমাহিত করা হয়।
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক । প্রকাশিত গ্রন্থ : ৩টি।
Leave a Reply