আলম তৌহিদ:
প্রচীনকালে চট্টগ্রামের শঙ্খ নদীর দক্ষিণ তীর থেকে আরো দক্ষিণে বিস্তৃত সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত রামু নামে একটি রাজ্য ছিল। রাজ্যটি কখনো শক্তিশালী, কখনো দুর্বল, আবার কখনো বিভিন্ন বিদেশী শক্তির পরাধীনতা স্বীকার করেছে। তবে বেশির ভাগ সময় রামু আরাকান শাসিত ছিল। অবস্থানগত কারণে রামুর যেমন রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল, তেমনি এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম ছিলনা।বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার আদর্শ উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ার কারণে রামু তৎকালীন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তখনও অধুনা কক্সবাজারের গোড়াপত্তন হয়নি। এই বিস্তীর্ণ উপকূল রামুর আওতাভুক্ত ভূখণ্ড ছিল।
রামুর আদি নাম নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কের শেষ নেই। আরাকান, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম কিংবা বাংলার ইতিহাস থেকে রামুর প্রাচীন নাম হিসেবে রাহমা, রাহমি, রামাই, রন্ভী, রাম্ভু, রম্যভূমি প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। অনেক প্রতিযশা গবেষক তাঁদের গবেষণা কর্মের মাধ্যমে এই নামগুলোকে বর্তমান রামু বলে শনাক্ত করেছেন। আবার কোনো কোনো লেখক রম্যভূমি নামটির সাথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে সম্পৃক্ত করে নতুন এক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। তাদের কেউ কেউ দাবি করেন রবীন্দ্রনাথ রামুকে ‘রম্যভূমি’ নামে ভূষিত করে বিশ্ব খ্যাতি এনে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সমুদ্র-যাত্রায় রামুর রামকোট বন্দরে অবস্থান ও রামুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো কাল্পনিক বিষয়কে বাস্তবতার আবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এম সুলতান আহমদ মনিরী এক প্রবন্ধে লিখেন-
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি কালজয়ী উপন্যাস ‘রাজর্সী’ ও বিখ্যাত নাটক ‘বিসর্জন’-এ রামুকে রম্যভূমি নামে ভূষিত করে বিশ্ব খ্যাতি এনে দিয়েছেন। অবশ্য কবি কখনো রামুতে পর্দাপন করেছিলেন বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। কিন্তু তাঁর জীবনীতে দেখা যায় তিনি একাধিকবার বঙ্গোপসাগর সাগর দিয়ে বার্মা বা অন্যত্র সমুদ্র ভ্রমণ করেছেন।
উল্লেখ্য,সেকালে বঙ্গোপসাগরের অন্তত দুইটি বড় খাড়ি বা চোছা রামুর অতীত সমুদ্র বন্দর রামকোট ও উত্তর মিঠাছড়ির নৌঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পূর্বদিকে বাঁকখালীর অনেক অভ্যন্তর পর্যন্ত জোয়ার-ভাটার প্রভাব ছিল। রবীন্দ্রনাথ সমুদ্র যাত্রায় রামুর উপকূল ঘেঁষে যেতে যেতে বা প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় রামকোট বন্দরে অবস্থান করা কোন অকল্পনীয় ঘটনা নয়। সেই সময়েই তিনি রামুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে রামুকে রম্যভূমি উপাধি দিতে পারেন।”১
সুলতান আহমদ মনিরীর এই বক্তব্য যথার্থ ইতিহাস সুলভ নয়। রবীন্দ্রনাথ ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি লিখা শুরু করেছিলেন ১২৯২ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। এটি তখনকার ‘বালক পত্র’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরের বছর ১২৯৩ বঙ্গাব্দে ‘রাজর্ষি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এটি মূলত রাজনৈতিক উপন্যাস। মন্দিরের সিঁড়ির উপর রক্তের দাগ দেখে একটি বালিকার জিজ্ঞাসা থেকে এই উপন্যাসের সূত্রপাত হলেও মূলত এর অবয়ব গড়ে উঠেছে ত্রিপুরারাজ গোবিন্দ মাণিক্যের কাহিনিকে কেন্দ্র করে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি ত্রিপুরার রাজা ছিলেন। তাঁর ভাই নক্ষত্ররায় সিংহাসনলোভী হওয়ায় তিনি স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে আরাকানরাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানেই উপন্যাসে উঠে এসেছে রামুর প্রসঙ্গটি। রবীন্দ্রনাথ যখন‘রাজর্ষি রচনা করেন,তখন ভারতে চলছে উপনিবেশিক শাসন। ভারতের ইতিহাসে-মানচিত্রে তখন রামু নামটি প্রতিষ্ঠিত। সবচেয়ে কঠিন সত্য এই যে, রবীন্দ্রনাথ একবারও তাঁর উপন্যাসে ‘রম্যভূমি নামটি ব্যবহার করেননি। তাঁর রচনা থেকে পাই ‘রামু নামটি।এখানে ‘রামু’ নামটি এসেছে কাহিনির প্রয়োজনে।এটাকে ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা বলা যায়। কারণ রামুকে বাদ দিলে গোবিন্দ মাণিক্যের কাহিনি অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়।
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘রাজর্ষি’ রচনা করেন তখন ভারতে চলছে ইংরেজ উপনিবেশিক শাসন। ভারতের ইতিহাসে-মানচিত্রে তখন রামু নামটি প্রতিষ্ঠিত। সবচেয়ে কঠিন সত্য এই যে, রবীন্দ্রনাথ একবারও তাঁর উপন্যাসে ‘রম্যভূমি নামটি ব্যবহার করেননি। তাঁর রচনা থেকে পাই ‘রামু নামটি। আর এখানে ‘রামু’ নামটি এসেছে কাহিনির প্রয়োজনে। এটাকে ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা বলা যায়। কারণ রামুকে বাদ দিলে গোবিন্দ মাণিক্যের কাহিনি অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়।
এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথ একজন মহান সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে বর্ণনা করেছেন এভাবে-
‘দক্ষিণ-চট্টগ্রামের রামু শহর এখনো দশ ক্রোশ দূরে। সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্বে গোবিন্দমাণিক্য যখন আলমখাল-নামক ক্ষুদ্র গ্রামে গিয়া পৌছিলেন,তখন গ্রামপ্রান্তবর্তী একটি কুটির হইতে ক্ষীণকণ্ঠ বালকের ক্রন্দনধ্বনি শুনিতে পাইলেন। গোবিন্দমাণিক্যের হৃদয় সহসা অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই কুঠিরে গিয়া উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, যুবক কুঠিরস্বামী একটি শীর্ণ বালককে কোলে করিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতেছে। বালক থর থর করিয়া কাঁপিতেছে এবং থাকিয়া থাকিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে কাঁদিতেছে। কুঠির স্বামী তাঁহাকে বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। সন্ন্যাসবেশী গোবিন্দমাণিক্যকে দেখিয়া সে শশব্যস্ত হইয়া পড়িল। কাতর স্বরে কহিল,“ঠাকুর, ইহাকে আশীর্বাদ করো ।”২
এ ছাড়া উপন্যাসের অন্যত্রও রামু নামটিই পাওয়া যায়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখেন-
‘রাত্রি শেষ না হইতে হইতেই গোবিন্দমাণিক্য গৃহস্বামীর নিকট বিদায় না লইয়াই অশ্বারোহণে রামু শহরের অভিমুখে চলিয়া গেলেন। আহার করিলেন না, বিশ্রাম করিলেন না। পথের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র নদী ছিল; ঘোড়াসুদ্ধ নদী পার হইলেন। প্রখর রৌদ্রের সময় রামুতে গিয়া পৌছিলেন।<cod৩
“রামুর দক্ষিণে রাজারকুলের নিকটে মগদিগের যে দুর্গ আছে, আরাকানরাজের অনুমতি লইয়া সেইখানে তিনি বাস করিতে লাগিলেন।”৪
উদ্ধৃত খণ্ডাংশগুলো ছাড়া উপন্যাসে রামু সম্পর্কে আর কোনো কিছুর অবতারনা দেখা যায়না।সুতরাং ‘রাজর্ষি উপন্যাসে ‘রম্যভূমি গল্প ফাদা আমরা মনে করি সঠিক ইতিহাস নির্ণয়ের অন্তরায়।
এবার আসি ‘বিসর্জন’ নাটকের নাট্যমঞ্চে।দেখি সেখানে কী আছে!‘বিসর্জন একটি কাব্যনাট্য।রাজর্ষি উপন্যাসের প্রথমাংশের কাহিনি নিয়ে এই নাটকটি রচিত হয়। এটি ১২৯৭ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই নাটকের কোথাও বা কোনো অংশে ‘রম্যভূমি’ বা ‘রামু ’ নামটির উল্লেখ নেই।
তথ্যপঞ্জি
১ প্রগৈতিহাসিক যুপাকীর্ণ রম্যভূমি রামু (প্রবন্ধ)-এম সুলতান আহমদ মনিরী
২ রাজর্ষি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ-১০০
৩ রাজর্ষি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ-১০২
৪ প্রাগুক্ত
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত বই ২টি
Leave a Reply