হাশেম সৈকত
মা র বয়স সত্তর কাছাকাছি। শরীরের গঠন হালকা- পাতলা। মায়ের মোটামুটি নিরোগ স্বাস্থ্য ছিল। মা কাজের মধ্যে ডুবে দিয়ে নিজেকে ব্যস্থ রাখতেন।
বাড়ির পাশে ছোট জায়গায় মা মৌসুম অনুযায়ী এটাওটা চাষ করতেন। ডেঁঢ়স, বরবটি, মরিচ, মিষ্টিকুমড়া, কলমিশাক সহ নানা শাকসবজির আরও কত কিছু। ওইখান হতে শাকসবজির চাহিদা কিছুটা মিটতো। আমি বাড়ি গেলে নিজেদের উৎপাদিত সবজি খেয়ে আনন্দ অনুভব করতাম। আমি শাক পছন্দ করি তা মার অজানা নয়। এইকাজে মায়ের সহযোগী বড়ভাবি ও বড়ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা। আমি যখন বাড়িতে ছিলাম, মাকে সহযোগিতা করতাম। মা এইসব কাজ করে খুব আনন্দ পেতেন। মাকে এইসব না করার জন্য বলতাম। মা বলতেন- কাজ না করলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়।
মা বেশ ভালই ছিলেন। দুই হাজার ছয়ের নভেম্বরে স্টোক করে বারর মৃত্যু হয়। বাবাকে হারানোর ব্যথা মা আমাদের বুঝতে দেয়নি। মা শক্ত ছিলেন। বোনদের বাসায় যাওয়া, ঘরের নাতিদের সাথে খেলায় মশগুল থেকে বেশ ভালো সময় পার করতেছিলেন। বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই মার শরীর ধীরেধীরে দুর্বল হতে থাকে। বছর তিনেক হল, মা ঝাল তরকারি খেতে পারেনা। মার জন্য হলুদ দিয়ে আলাদা রান্না করা হয়। মায়ের হলুদের রান্নায় বড় ভাইয়ের দুই পিচ্ছি ভাগ বসায়। শীতকাল আসলে মায়ের গোসল ও অজুর জন্য পানি গরম করা হয়। গরম পানি পান করতে দেওয়া হয়। সবার দৃষ্টি মার দিকে।
দুই হাজার সতেরোর অক্টোবরের এক সোমবার আমাদের পরিবারের বড় সন্তান, বড় আপার স্টোক করে মৃত্যু হয়। আপা মারা যাওয়ার পর থেকে মা বেসামাল পড়ে। আপা কে হারিয়ে মা কাতর। সোমবার আসলেই কান্না করে। এরপর থেকে কারো সাথে মোবাইলে কথা বললে, অথবা বাড়িতে কেউ আসলে মা কান্না ছাড়া কথা বলতে পারেনা। একা থাকলে কান্না করে। এরই মধ্যে মার দৃষি শক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসে। মাকে ভালো রাখার জন্য আমাদের অবসর নাই।
করোনা সংকটে মার্চের মাঝামাঝি বাড়ি চলে আসছি। সার্বক্ষণিক মার পাশে থাকি। হোম কোয়ারেন্টাইনে মায়ের প্রতি সবাই সজাগ হই। কেউ যেন মায়ের সংস্পর্শে আসতে না পারে সে ব্যবস্থা করি। যথা সময়ে রমজান এসে উপস্থিত। আমরা মা কে অনুরোধ করলাম, মা যেন রোজা না ধরে। আমরা মাকে শুনাতে পারিনি। মা বললেন- দেখি কয়টা করা যায়, না পারলে করব না। কোন রকম সাত রোজা শেষ করতে পারলেও আট রোজার সেহেরি খেতে উঠে মা আর হাঁটতে পারেনা, বসা থেকে উঠতে পারেনা। দুর্বল শরীর আর সমর্থন করছেনা। এইবার রোজা বন্ধ করালাম। কিন্তু মা রোজা ছেড়ে দিতে রাজি নই। আমরা মাকে আশ্বস্ত করলাম, অবশিষ্ট রোজা আমরা (সন্তানেরা) পালন করবে। তবুও মার অক্ষেপের শেষ নাই।
মা এখন খুবই দুর্বল। শুখিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। খায় অল্প। একা বসা থেকে উঠতে পারেনা, হাঁটা চলা করতে পারেনা। কেউ একজন কে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়, গোসল করিয়ে দিতে হয়। বিছানায় শুইয়ে দিতে হয়। যে মা চলাফের করতে পারত, সেই মা চোখের সামনেই অচল হয়ে গেল। ভেঙ্গে আমার সব চুরমার গয়ে গেল।
মা রোজা রাখতে না পারলেও, তের রমজান থেকে বসে বসে নামাজ আদায় করতেছে। আল্লাহ তুমি মার দোয়া কবুল কর।
পৃথিবীতে যখন কেউ কারও খবর নেয়না, তখন শুধু মাই থাকে সন্তানের খবর নেওয়ায়। সমস্ত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। কী খেয়েছি, কোথায় আছি, পকেটে কত টাকা আছে।
মা অসুস্থ, দুইহাত তোলে মায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া করি।
পৃথিবীর সব মা ভালো থাকুক।
Leave a Reply