নতুন কবিতার জন্ম : নতুন কবিতা কিভাবে জন্ম হয় জানি না। ভাষার তীব্র গভীর অনুভব। সবকিছু ভেঙে চুরে ফেলার তূমুল স্পর্ধা, ভাষার বিন্যাসে নতুনত্ব। সময়কে শাসন করার এক স্বাভাবিক প্রবণতা, দীর্ঘ অনুশীলন এবং শ্রমজীবি মানুষের বেদনাকে ধারণ করা তার সংবেদনশীল প্রয়োগ, তীক্ষ্ম দৃষ্টি আরও আরও গভীরতা একসঙ্গে কাজ করলে বুঝি নতুন কবিতার জম্ম হয়। কবি মনির ইউসুফের এই পর্বের কবিতা সে রকম নিবেদন, দায় বুকে নিয়ে বুঝি সৃষ্টি হয়েছে। বেদনার বিম্বিত বুকে সে সব কবিতায় অবগাহনের জন্য রাইজিং কক্সের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো- (কালাম আজাদ)।
ঝিনুক কুড়াতে কুড়াতে
আবার সমুদ্র তীরে ঝিনুক কুড়াতে কুড়াতে
পেয়েছি তোমায়
আবার সমুদ্র তীরে শামুক কুড়াতে কুড়াতে
হারিয়েছি তোমায়
হারনোর বেদনা কি যে ব্যথায় দীর্ণ
সে তুমি কখনও বুঝবে না গো কখনও বুঝবে না
তাই আমি নিজের সঙ্গে নিজে নিজে কথা বলি
পৃথিবীর এই বারান্দায়
পাওয়ার সুখ ঢেউয়ের পাপড়িতে ছড়ানো
ইন্দ্রজালিক মৃন্ময়, ক্ষণিকের তাড়না
সে সুখ উড়ে যায় ঝড়ো বাতাসে কোন এক সন্ধ্যায়
তাই আমি নিজের সঙ্গে নিজে নিজে কথা বলি
পৃথিবীর এই বারান্দায়
সমুদ্র ও আমি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে
ব্যথার দহন বুকে নিয়ে বালুচরে মিশেছি
আর তপ্ত লবণজলে দ্রবীভূত হয়েছি
তাই, সন্ধ্যার এই ঝিরিঝিরি বাতাসে
আত্মার সেই ক্ষতে কে তুমি প্রলেপ দাও
পৃথিবীর এই বারান্দায়
আমাদের নতুন পৃথিবী আমাদের নতুন আকাশ
আমি দেখতে চাইনি মালিক সোবহানের
অভিমান ক্ষুব্ধ ও রাগী চোখ
আমার সহ্য হবে না
আমার সহ্য হবে না
সবুজ ধানের চারায় তেপান্তরের দোলা
বৃদ্ধ মায়ের অবুঝ চোখের মায়া
আহত বেদনা নিহত বেদনা
আহত মন আহত মন আহত মন
আহত পৃথিবী ঘাতক প্রচলিত অজ্ঞতা
মালিক সোবহানের তেজোদ্দীপ্ত বুক
অনেক স্বপ্নের মুদ্রিত চোখ
আমি দেখতে চাইনি
আমার সহ্য হবে না আমার সহ্য হবে না
ভেঙে ফেলো সময়, দুঃখের কণা
স্মৃতির আকুলতা
ধানের তোড়ের চেয়ে প্রাণময়
সেইসব দিন, সেইসব ভোর
জড়ানো আশমলতা, মসজিদের ঘাট
আমি দেখতে চাই না
আমার সহ্য হবে না আমার সহ্য হবে না
বাতাসে ফিসফাস বাতাসে ফিসফাস
কুয়াশা হেমন্তের ধান কাটা বিল
ডুমুর ফলের গাছে বুলবুলি
কবরস্থান, সবুজ ঘাস আর ‘মা’
আহত বুক নিহত বুক
নিহত মন নিহত মন নিহত পৃথিবী
আমাদের নতুন পৃথিবী নতুন আকাশ
নতুন সূর্যের কিরণছটা
নতুন দিনের স্বাপ্নিক
ভাই মালিক সোবহান মালিক সোবহান
ছিদ্দিকী সাবের হুদার পর
আমাদের নতুন পৃথিবীর উজ্জ্বল নক্ষত্র
সুপারী গাছের আঁচলে জড়ানো
হিম, শিশির, কুয়াশামাখা ভোর
আযান মোরগ ও কাকের ডাক
আমাদের নতুন পৃথিবী নতুন আকাশ
ডুলা ফকির মোক্তার পাগলা পেটান ফকির
জরিনা ফকির কালু ফকির
আধ্যাত্মিক নারী ও বারআউলিয়া
মালিক সোবহান মালিক সোবহান
আমাদের নতুন পৃথিবী আমাদের নতুন আকাশ
বলীখেলা মাহফিল ডুলুইন্না মোড়া
আমার দাদা-দাদী আমার জাগ্রত সুন্দর
জেগে ওঠে বঙ্গেপসাগরের তীর
আমাদের বেদনার তীর্থ, আহা!
স্মৃতির বিষাদ বিষণ্নতা, তীব্র বিষণ্নতা
বিষণ্নতা বিষণ্নতা বিষণ্নতা
মালিক সোবহান মালিক সোবহান
আমাদের নতুন পৃথিবী নতুন আকাশ
আমাদের নতুন পৃথিবী আমােদর নতুন আকাশ
তুমি নেই তুমি নেই তুমি নেই তুমি
নক্ষত্র সন্তান, আমাদের নক্ষত্র সন্তান
রাস্তার ঘাস, বুলবুলি, ধূলি, ইট
তোমার সান্নিধ্যের জন্য এখনও পাগল
ভাই মালিক সোবহান মালিক সোবহান
তোমার অভিমান ক্ষুব্ধ রাগী ও তেজোদীপ্ত চোখ
আমি দেখতে চাইনি
আমার সহ্য হবে না আমার সহ্য হবে না
তোমাকে ছাড়া
আমাদের নতুন পৃথিবী নতুন আকাশ
গোছাতে পারি না গোছাতে পারি না
কস্তুরা ঘাট, আমি ও খালেদ মাহবুব মোর্শেদ
বিকেলের আকাশ নক্ষত্রের চাদরে জড়ানো
আমি ও খালেদ মাহবুব মোর্শেদ
শুকতারা বুকে নিয়ে বসে থাকি কস্তুরাঘাট
শিরশির আর্দ্রতা আর বেহেস্তী ধুম
হৃৎপিণ্ড ছুয়ে উড়ে যায় উড়ে যায়
মিশে যায় মিশে যায় পৃথিবীর বাতাসে
খালেদ মাহবুব মোর্শেদ আর আমি
কবিতা নগ্নিকা পরকীয়া আর সাগরের ঢেউয়ের রূপ
ভেঙে ফেলি পৃথিবী গোলক
আমাদের নতুন পৃথিবী আমাদের নতুন আকাশ
বাইগাছ ঝাউবন প্যারাবন বকের ঝাঁক
নতুন গাঙচিল
আমাদের নতুন পৃথিবী নতুন আকাশ
আমাদের নতুন কবিতা
আমাদের বুকের কবিতা
আমাদের প্রচণ্ড বিষাদ
আমাদের করুণ আকুলতা
আমাদের হা হুতাশ, হা হুতাশ
তীর ভেঙে মন ভেঙে বুক ভেঙে
বেঁচ থাকা বেেঁচে থাকা বেঁচে থাকা
দইনের দুঃখ, দইনের দইন
সাগরে ভাসা, অজস্র মৃত্যু লাশ
সাগরে ভাসা সাগরে ভাসা
জীবন ও জীবীকা, জীবীকা জীবীকা জীবীকা
মাছমারা মাছমারা মাছমারা
আমাদের নতুন আকাশ আমাদের নতুন পৃথিবী
আমাদের নতুন কবিতা
আমি ও আলী প্রয়াস মগীবর্মী রাখাইন পোয়েনাচ
দুটি আঙুলের উপর দিয়ে ভর করে
মেয়েটি নাচে মগীবর্মী রাখাইন পোয়েনাচ
ধারালো ছুরি খত্তাল ঢোল ড্রাম খোল
চৈত্রসংক্রান্তি আজ রাত
টেকনাফ যেন উৎসবে মাতোয়ারা
আধুনিক টেকনাফ অবগুণ্ঠন খুলছে
মগ মুসলিম হিন্দু বড়ুয়া রাখাইন সবার উৎসব
অনাবৃত রাখাইন মেয়ে না দেবী না নারী না মানবী
ড্রামের শব্দ জখমী ছোরা মৃত্যুর হাতছানি
আমি ও আলী উৎসব বুকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছি
জীবনের চৈত্র সংক্রান্তি
আমাদের প্রলুব্ধ করেছিল পৃথিবীর বুক
আমাদের প্রলুব্ধ করেছিল রাখাইন রোহিঙ্গা নারী
নীলনাফ জঙ্গল বাঘের হিংস্র হুঙ্কার গরুর আর্তনাদ
হরিণের ঝাঁক, মামুর পাল
গরীব চাষীর পুষ্টিহীন শরীর, পানচাষী
কাঠুরিয়ার বলিষ্ঠ বাহু চোয়াল
আর আমাদের নতুন তরমুজ ক্ষেত
আমাদের লাল কবিতা
আমাদের সবুজ-সবজি রূপালবণ
আর অগণিত মগবর্মী রাখাইন রোহিঙ্গা
বাঙালি রমণী
আমরা প্রলুব্ধ হয়নি
মা মায়ের মুখ আমাদের থামিয়ে দিয়েছিল
আমরা ডাকলাম মা- মা
আকাশ বিছিয়ে দিল তারার আঁচল
আলোয়ার জোয়ার জলো মেঘের শ্রাবণ
আশ্রয় আশ্রয় আশ্রয়
আমরা আশ্রয় পেয়েছিলাম মায়ের আঁচলে
আমাদের নতুন পৃথিবী ঐতিহাসিক জাদী
আমরা শ্যামল তরুণ রক্তে তুমুল উন্মাদনা
বঙ্গোপসাগরের তীর আমাদের হৃদয়
আমাদের রক্তের তীব্রঘন তোড়জোড়
অনাদৃত টেকনাফ অনাবৃত ঘুমধুম ব্রিজ
আর সুদূরের সীমাহীন আকাশ সীমাহীন আকাশ
মগী তলোায়ার ছুরি লাইটার বিচিত্র দেশ
জাদিমোরা মাথিন আহা! মাথিন
আমাদরে রক্তাক্ত কবিতা
আমাদের রক্তাক্ত বুক
আমাদের নতুন কবিতা
আমাদের নতুন কবিতা
চলন্ত ট্রাক, আমি ও নুপা আলম
চলন্ত ট্রেন টেকনাফের ভেতর দিয়ে চলে যাবে চীন
সে নতুন উদ্যম রক্ত শিরাউপশিরা
টান টান উত্তেজনা, গতির গোলক, চঞ্চল
মার্শাল আর্ট বার্মিজ তলোয়ার চায়না বন্দুক
পিস্তল- ভয়ঙ্কর ধারালো ছাকু বিচিত্র গুলতি
মসৃণ পেলব হাতপাখা
আমাদের বেড়ে ওঠা মন, মননে রঙিন শৈশব
আমাদের তারুণ্য গোপন হিরো সীমান্ত আর নীলনাফ
কার্তুজ সিগেরেট বারুদ বন্ধুদের গোপন ফিসফাস আলাপ
আর অবারিত চারণভূমি মেয়েদের নিয়ে সতর্ক আলাপ
আমাদের নতুন কবিতার ঘ্রাণ-গন্ধ উত্তেজনা
আমাদের বলীখেলা ষাঁড়ের লড়াই
মোরগ লড়াই লালঝুটি- কালাঝুটি
আমাদের ছলকে ওঠা রক্ত
সীমান্তে কাঁটাতার বেতবুনিয়া নোম্যানসল্যান্ড
মেইন রোডে চলন্ত ট্রাক চলন্ত ট্রাক চলন্ত ট্রাক
আমাদের মেরুদণ্ড আমাদের শিরদাঁড়া
বাঘ ভাল্লুক বাঘডাশ, হাতি হরিণ রাত্রির ভয় ও সাহস
‘হাতের পাঁচঘায়ে হৃৎপিণ্ড ফাটানোর কৌশল’
আমাদের পাঞ্জা লড়াই আমাদের উদ্যমতা
নতুন মেয়ে নতুন মেয়ে নতুন মেয়ে
অস্থিরতা অস্থিরতা অস্থিরতা
গভীর সমুদ্র আদম স্রোত নক্ষত্রের দৌড়
সমতল বালুরাশি আদিম উন্মাদনা
শতাব্দীর আগুনে পুড়েছি আমি ও নুপা
নাফের আকাশ আকাশে মিন রাশি
আমাদের কর্কট গাণিতিক সূত্র
আমাদের উপোস থাকা, আমাদের উপোস থাকা
আমাদের উপোস থাকা
লাল চোখ রক্তদানা হলুদ চোখ কারো বুঝতে না দেওয়া
আমাদের উপোস থাকা আমাদের উপোস থাকা
আমাদের উপোস থাকা
আহা! সোনালি কবিতা গোলাপী কবিতা
আমাদের নতুন পৃথিবী আমাদের নতুন আকাশ
পড়ুন –মনির ইউসুফের কবিতা
এই শল্যগ্রহে
Leave a Reply