ঝর্না বড়ুয়া
বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি। শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমা তিথি রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ বা বোধিজ্ঞান ও বুদ্ধের মহাপরিনির্বান লাভ এ ত্রিস্মৃতি বিজড়িত । সাধারণত বিশ্বের কোন মহামানবের জীবনে তিনটি প্রধান ঘটনা একই তিথিতে সংঘটিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই । সংগত কারনে এ দিনটি সমগ্র বৌদ্ধদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন বা পূর্ণিমা। ত্রিস্মৃতি বিজড়িত মহান এ দিবসটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে বড় পবিত্র ও মহান। বিশ্বে এ দিনটি যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাব গম্ভীর মর্যাদায় উদযাপন হয়ে থাকে। জাতিসংঘ দিনটিকে ” VESAK DAY ” হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অহিংসা ও শান্তির বাণী প্রচারক হিসাবে বুদ্ধ এখনো বিশ্বে মানবজাতির হৃদয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধার আসন অলংকৃত করে আছেন। তিনিই সর্বপ্রথম “জগতের সকল প্রাণীর সুখ ” কামনা করেছিলেন।
খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে চিনের কনফিউশিয়াস, পারস্যে জরাথ্রুষ্ট, ভারতে মহাবীর ও মহামতি বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে । মানব জীবনের দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় সত্য আবিস্কার করেন । বুদ্ধ মানবজীবনের দুঃখ মুক্তির উপায় আবিস্কারক হিসাবে এক নব বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তথ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবী জয় করেছেন । আড়াই হাজারেরও বছরের অধিক কাল তিনি সমান আসনে অধিষ্ঠিত আছেন । তাঁরই নীতি ও আর্দশ অনুসারীরা ” বৌদ্ধ ” নামে পরিচিত । বুদ্ধের মূল আদর্শ মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা, সাম্য, অহিংসা, মানবতাবাদ ও নিরপেক্ষতা। ভারতীয় সমাজের জাতিভেদ, বর্ণভেদ, বৈষম্য ও বর্ণপ্রথায় নিপীড়িত সমাজে বুদ্ধের নতুন আদর্শ ও নীতি মানব মনের শান্তি ও স্বস্তি দিয়েছিল । সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে মানবজীবনের হতাশা ও ব্যর্থতার সৃষ্টি হয়েছিল ~ সেই ব্যর্থতা থেকে মানবজাতিকে পরিত্রাণ দিয়ে তথা মানবতাকে উদ্ধার করে গণমুখী গ্রহণযোগ্য জীবন পদ্ধতির নির্দেশ দিয়েছিলেন । যে সমাজে নারীরা অবহেলিত পিছিয়ে ছিলেন তাদের এই দুঃসহ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিয়ে পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন । সেদিক থেকে আমি বলি, নারী পুরুষ বৈষম্য নিয়ে সর্বপ্রথম মানবপুত্র ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মহামতি গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রথম দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তিনিই গনতন্ত্র ও সাম্যবাদের প্রথম স্রষ্টা ।
খ্রীস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে নেপালের কপিলাবস্তু নগরে লুম্বিনী নামক উদ্যেনে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রাজা শুদ্ধোধন ও মাতা মহামায়া রাজপুত্রের নাম রাখলেন সিদ্ধার্থ । পুত্রের জন্মের সাতদিন পর মাতা মহামায়ার মৃত্যু হলে বিমাতা মাসিমা মহাপ্রজাপতি গৌতমী তাঁকে লালন পালন করেন বলে তাঁকেই গৌতম নাম রাখা হয় । ছোটকাল থেকে সিদ্ধার্থ গৌতমকে মহাঐশ্বর্য্য রাজসুখ কোন কিছুকে আকৃষ্ট করতে পারিনি । শৈশব থেকে বেদ, পূরাণ, ইতিহাস, যোগ, বৈষয়িক, ন্যায়, গণিত, চিকিৎসা বিদ্যা, রাজনীতি, মৃগয়া, ধনুবিদ্যা, অশ্বারোহণ রথ চালনা বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন । রাজপুত্রের সুখের জন্য পিতা শুদ্ধোধন রাজা গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত এ তিন ঋতু উপযোগী প্রাসাদ নির্মাণ করে দিলেও রাজকীয় ভোগবিলাস তাঁর মনকে আকৃষ্ট করতে পারেনি ।সুযোগ হলে ধ্যানে মগ্ন হতেন, উদাসীনতা ও চিন্তিত হতেন । জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু তাঁকে বারবার ব্যথিত করতেন । কিভাবে এ দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তা তাঁর চিন্তাজগতকে ভাবিয়ে তুলেছিলেন ।
খ্রীস্টপূর্ব ৫৯৪ অব্দে সিদ্ধার্থগৌতম ২৯ বৎসর বয়সে টগবগ পূর্ণ যৌবনে পরমা সুন্দরী স্ত্রী যশোধরা ও সদ্য জন্মজাত পুত্র রাহুলের মায়া ত্যাগ করে শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজপুত্র ধুলোর পৃথিবীতে নেমে আসেন । সেই এক অভাবনীয় ত্যাগ যা বর্তমান সময়েও চিন্তা করা যায় না । রাজপুত্র কিভাবে এতো মায়ামোহ, ঐশ্বর্য ও রাজসুখ ত্যাগ করে মানবের কল্যাণে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের জন্য গৃহত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন ~ তা ভাবলেই শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে ।এ ত্যাগ তাঁর জীবনকে মহিমান্বিত করেছেন । এখনো হৃদয়ের অঞ্জলি দিয়ে অর্ঘ্য, পুজা ও বন্দনা করে যাচ্ছে পৃথিবীর অগণিত পুজারীরা।বারবার নমি মানবপুত্র বুদ্ধকে।
খ্রীস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে ৩৫ বৎসর বয়সে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমাতে গয়ার বোধিদ্রুম মূলে সিদ্ধার্থ গৌতম তাঁর সেই আকাঙ্খিত দুঃখ মুক্তির উপায় “বোধিজ্ঞান ” বা “বুদ্ধত্ব লাভ ” করেছিলেন । বোধি শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা বা জ্ঞান । তখন থেকে তিনি “গৌতম বুদ্ধ ” নামে খ্যাত হয়েছিলেন । দীর্ঘ ৬ বৎসর কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে মানবের দুঃখ মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন । এ সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি উপলব্ধি করেছেন কঠোর তপস্যা আবার কৃচ্ছ্রতা সাধনে মুক্তি আসে না তাই ” মধ্যমপথ ” অনুশীলনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।বোধিলাভের প্রথম অভিজ্ঞতায় প্রকাশ করেছিলেন,
” অনেক জাতি সংসারং সন্ধাবিসসং অনিববিসং
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পুনং ( ধম্মপদ ১৫৩)
গৃহকারকের সন্ধান করিতে গিয়া তাঁহাকে না পাইয়া সংসারে অনেক জন্ম পরিভ্রমণ করিয়াছি,
পুনঃ পুনঃ জন্ম দুঃখজনক ।
দ্বিতীয় উদান গাথায় বলেছিলেন,
গহকারক! দিট্ঠোসি পুন গেহং ন কাহসি
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসঙ্খিতং
বিসঙ্খারগতং চিত্তং তণহানং খয়মজ্ঝগা (ধম্মপদ ১৫৪)
গৃহকারক! এক্ষণে আমি তোমার সন্ধান পাইয়াছি, তুমি পুনরায় গৃহ নির্মান করিতে সমর্থ হইবে না| তোমার সমুদয় পাশ্বর্ক ভগ্ন এবং গৃহকূট বিচ্ছিন্ন হইয়াছে| সংস্কারমুক্ত চিত্ত সমুদয় তৃষ্ণার ক্ষণ সাধন করিয়াছে।
বুদ্ধের দর্শন হলো, দুঃখ, দুঃখের কারন, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় সংক্ষেপে চতুরার্য সত্য । এ চারি আর্যসত্য কে জীবন দর্শন দিয়ে উপলব্ধি ও অনুশীলনের একমাত্র পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ । সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি । মহাকারুনিক বুদ্ধ সর্ববন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করাকে “নির্বান” বলে আখ্যায়িত করেছেন ।নির্বান শব্দের অর্থ নিভে যাওয়া, বিলুপ্তি, বিলয় ও অবসান অর্থাৎ নির্বান হলো সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ ।
বুদ্ধত্বলাভের পর সর্বপ্রথম সারনাথে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যগনের ( কৌন্ডিন্য, বপ্প, ভদ্রিয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ) কাছে তাঁর নবাবিস্কৃত ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন তা ” ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র ” হিসাবে পরিচিত। এইদিন ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি | তিনি সংঘ সৃষ্টির মাধ্যমে এ ধর্ম প্রচারে ভিক্ষুসংঘকে আহবান করেছিলেন, এধর্ম আদিতে কল্যান, মধ্যে কল্যান ও অন্তে কল্যান । এ কল্যানকর ধর্ম ” বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়” দীর্ঘ ৪৫ বৎসর তাঁর অমৃতময় বানী বহু রাজা, মহারাজা, রাজপুত্রগন, বহু মহীয়সী নারী, সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণীর নারী পুরুষ বুদ্ধের ধর্ম গ্রহণে মার্গ ফল লাভ করেছিলেন । এ ধর্মবানী দিক বিদিক ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষ সহ পুরো এশিয়া জুড়ে । বুদ্ধের মানবধর্ম সবার মনকে জয় করলো । যে ধর্ম প্রচারে ইতিহাসে কোন রক্তপাত নেই, জোড় নেই, শুধু মানবের কল্যানে নিবেদিত । তিনি মোট ৮৪ হাজার ধর্মস্কন্ধ প্রচার করেছিলেন । তা তিনটি পিটকে লিপিবদ্ধ যথাক্রমে সুত্র পিটক, বিনয় পিটক ও অভিধর্ম পিটক নামে পরিচিত ।তিনটি পিটকের সমন্বয়কে ত্রিপিটক বলা হয়ে থাকে। ত্রিপিটককে সংক্ষেপে বলা যায়,
” সব্ব পাপসস্ অকরণং কুসলসস্ উপসম্পদা
সচিত্ত পরিয়োদপনং এতং বুদ্ধানসাসনং ” ( ধম্মপদ ১৮৩)
সর্ব পাপ থেকে বিরত থাকা, কুশল কর্ম সম্পাদন করা, চিত্তকে পরিশুদ্ধ রাখা~ইহাই বুদ্ধের অনুশাসন।
আনন্দ স্থবির প্রধান সেবক, মহামোগগল্লান ও সারি পুত্র যথাক্রমে অগ্রশ্রাবক ও মহাশ্রাবক, ক্ষেমা ও উৎপলাবর্ন্যা অগ্রশ্রাবিকা ও মহাশ্রাবিকা, মিগারমাতা বিশাখা মহা উপাসিকা ও অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠী মহাউপাসকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
অবশেষে খ্রীস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দের তিনি কুশীনগরে যমক শালবৃক্ষের নীচে পবিত্র বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ৮০ বৎসর বয়সে মহাপরিনির্বান লাভ করেন । এখানে উল্লেখ করা যায়, একজন রাজপুত্র হয়েও তাঁর জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ ও মহাপরিনির্বান লাভ সবটায় প্রকৃতির মধ্যেই বৃক্ষের ছায়াতলে । এতে সহজে অনুমেয় পৃথিবীর সবকিছুই অনিত্য ও পরিবর্তনশীল। মহামতি বুদ্ধ তাঁর প্রচারিত ধর্মে সর্বপ্রাণীর সুখ শান্তি ও কল্যান কামনা করেছিলেন । শুধু মানব জীবনের নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও ক্ষমা পোষন করেছিলেন । তিনি প্রাণীর প্রতি দয়া বা প্রেম থেকে সেই যুগে “প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকার” যে নীতি দিয়েছেন তার বর্তমান বিশ্বেরও শিক্ষনীয় ও গ্রহনীয়।প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আজ আমরা যে কঠিন COVID – 19 মহামারীতে পুরো বিশ্ব আতঙ্কিত তার থেকে উত্তোলনের একমাত্র উপায় প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক জীব জগৎকে সংরক্ষণ করা । তিনি সমাজ জীবনের একটি শ্রেণীকে (ভিক্ষু সংঘ) বৃক্ষ কাটতে নিষেধ করেছেন । প্রাকৃতিক পরিবর্তন ধারাকে উদাহরণ দিয়ে বহু শিক্ষা দিয়েছেন মানব জীবনকে উন্নত করতে । জন্ম থেকে পরিনির্বান সময় পযর্ন্ত সারা জীবন বন পাহাড়ে অতিবাহিত করেছেন।তাঁর এ শিক্ষা বিজ্ঞানসম্মত ।
তাঁর গৃহীদের পালনীয় পঞ্চাঙ্গশীল বহুগুনসম্পন্ন ও নৈতিকতাসহ আদর্শ মানবচরিত্র গঠণে এক মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । যা পালনে সুন্দর সুশৃঙ্খল মানবজীবন গঠন করে প্রকৃত সুখ ও শান্তি লাভ করা যায় । বর্তমান অশান্তির পৃথিবীতে আমরা যদি প্রত্যেকে এই পঞ্চশীলের আওতায় আসতে পারি বিশ্ব শান্তিময় ও সুখময় হয়ে উঠবেই ।এমন কি মানবের লোভ, দ্বেষ, মোহ ক্ষয় হয়ে মৈত্রী ও ভালবাসা জাগ্রত হবে । ভয়ভীতি দূর হবে । বিশ্ব শান্তি ও সুখের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হবে ।এ দূর্লভ মানব জীবন সুখের ও সার্থক হবে । একমাত্র মনুষ্য জীবনে পুন্য বা কুশল কর্ম করার সুযোগ রয়েছে । দান শীল ভাবনা আরও শীল সমাধি প্রজ্ঞা অনুশীলনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা লাভ করলেই এ জীবনে মুক্তি বা নির্বান । বৌদ্ধ দর্শনে কর্ম ও কর্মফলের বিশ্বাস রেখেই তিনি পথচলার শিক্ষা দিয়েছিলেন ।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান অশান্ত পৃথিবীতে মহামতি বুদ্ধের মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার জয় হউক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক ।
আবারও বুদ্ধ পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছাসহ শুভ কামনা থাকলো ।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক ।
লেখক :
লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া
ইউ এস এ।